ভরা বর্ষা মৌসুমে ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র খ্যাত ভোলার গজারিয়া থেকে
পটুয়াখালীর কলাপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার নদী ইলিশ
শূণ্য। তেঁতুলিয়া নদীর তীর ঘেঁষে পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার ১২টি জেলে
পল্লীতে চরম আকাল ঈদ আনন্দ নেই বসতিদের।
পুরো আষাঢ় ও শ্রাবনের এই ভরা বর্ষায় এক সময় তেঁতুলিয়ার কূলে কূলে ছোট বড়
একাধিক মাছঘাটে ইলিশ ধরার উৎসব চলত। জেলে, দাদনদার, আড়তদার, দালাল,
পাইকার আর ফরিয়াদের পদচারণায় প্রতিটি মাছঘাট সারাদিন থাকতো মুখরিত। এখন
ওই ঘাটগুলোতে চলছে শুনশান নিরবতা। খাঁ খাঁ করছে প্রতিটি আড়তের মাছের
ডালিগুলো। দু'চার জনকে অলস সময় কাটাতে দেখা যাচ্ছে।
বাঁশবাড়িয়ার জেলে পল্লীর বজলু গাজী, বাবুল ফরাজী, শুক্কুর মাঝি এ
প্রতিনিধিকে জানান, এখন বর্ষার ভরা মৌসুম। নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ার
কথা। কিন্তু নদীতে গেলেই শূণ্য হাতে ফিরতে হয়। বিগত বছরগুলোর এই সময়ে
দশমিনার বাঁশবাড়িয়া, ঢনঢনিয়া, হাজিকান্দা, গোলখালী, কাঁটাখালী, সৈয়দ
জাফর, আউলিয়াপুর, চরঘুনি, পাতারচর, চরহাদি, চর বোরহান ও চর শাহজালাল
এলাকার হাজার হাজার জেলে ইলিশ ধরত। প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকার ইলিশ
রপ্তানির উদ্দেশ্যে ঢাকা, চাঁদপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো
হতো। মাছের আড়ৎ ব্যবসায়ীরা মজিবুর রহমান আজবাহার প্যাদা জানান, তেঁতুলিয়া
নদীর বিভিন্ন মাছ ঘাটে জেলেদের মাঝে জাল, ট্রলার কিনে দেয়াসহ বিনিয়োগ
রয়েছে প্রায় টি টাকা। ওই টাকার লাভতো দূরের কথা মূল টাকা ফেরত পাওয়া
নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তারা। মহাজনের ঋণের বোঝা আরো বাড়ছে।
দাদনের যাতাকল থেকে মুক্তির শ্লোগান নিয়ে কাজ করা এনজিও কর্মীদের ক্ষুদ্র
ঋণ ও সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিদ্বন্দিতায় জেলেদের সর্বস্বটুকুর
মালিকস্বত্ব হারিয়ে আজ নিঃস্ব। ঋণের হাল করণ শুরু হয় এ মাসেই। বিভিন্ন
এনজিও তথ্য মতে ঋণ গ্রহিতা প্রায় ৫ শতাধিক জেলে খুঁেজ পাওয়া যাচ্ছে না।
ঋণের বোঝা কাধে নিয়ে স্ত্রী সন্তানসহ ঢাকা-চট্রগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে
পালিয়ে গিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
উপজেলা সদর বাজারের রয়েছে প্রায় ২ শতাধিক ইলিশ ব্যবসায়ী। বাজারে ইলিশ না
আসায় তাদেরও দূঃসময় যাচ্ছে বলে একাধিক ইলিশ ব্যবসায়ীরা জানান।
ক্ষুদ্র মৎস্যজীবি সমিতির সভাপতি সিকদার নজরুল ইসলাম সেচ্ছাসেবী সংগঠন
কোডেক পরিসংখ্যান উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, উপজেলায় মাছ ধরা পেশায় ১৩ হাজার
মানুষ জড়িত। সিডর-আইলা ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা সরকারের জেলে পূনর্বাসনের
সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। স্থানীয় দালাল ও ক্ষমতাসীন দলের একাধিক চক্রের
যোগসাজঁশে মাছ ধরা পেশায় জড়িত নয় এমন লোকজন বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে
সরকারের প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে।
জেলেরা জানায়, ইলিশের এরকম আকাল গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের মানুষ দেখেনি।
আড়ৎদার মিরাজ খান জানান, ইলিশ হচ্ছে গভীর জলের মাছ। জৈষ্ঠ্য মাসের
মাঝামাঝি থেকেই বঙ্গোপসাগর ও তেঁতুলিয়ার মোহনায় স্রোতের গতি বেড়ে যেত।
ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ নদীতে উঠে আসত তখন। কিন্তু বর্তমানে সাগর মোহনার
প্রবেশ মুখে তেঁতুলিয়া নদীতে বিশাল বিশাল চর পড়ে যাওয়ায় ইলিশ মাছ আর
নদীতে উঠে আসছে না।
চর বোরহানের জেলে পল্লীর জালাল রাঢ়ী, হাসেম ফকির ও রফিজ বয়াতি জানান, একে
তো মা ইলিশ নিধন ও জাটকা আহরণে সরকারী অবরোধে বছরের বড় এক সময় বেকার দিন
যায়। তার ওপর মৌসুমে ইলিশের দেখা না পাওয়ায়, পরিবারের সদস্যদের মুখে ভাত
তুলে দিতে হিমশিম খাই। তেঁতুলিয়া নদীতে ইলিশ মাছের এই আকাল হওয়ায় জেলেরা
নদীতে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ কারনে জেলে পাড়ায় চলছে হাহাকার। ঈদের
জন্য বাড়তি পোশাক-আষাক কেনার সামার্থ নাই। এ পল্লীর অনেক জেলেই অভাব অনটন
আর ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে দিন মজুরের কাজ
করছেন। চরশাহজালালের জেলে পল্লীর গৃহবধূ নাছরিন বেগম জানান, নদীতে মাছ না
থাকায় তার স্বামী সোবাহান প্যাদা শ্রমিকের কাজ করতে চিটাগাং চলে গেছে।
ঘরে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে নুন ভাত খেয়ে রোজা রেখেছেন। এমন চিত্র এখন
দশমিনা উপজেলার প্রতিটি জেলে পল্লীতে।
যার চরম প্রভাব পড়েছে ঈদে অধিক কেনা-বেচার ব্যবসায়ীদের উপর। উপজেলা সদর
বাজারের জান্নাতুল ফ্যাশন গার্মেন্ট মালিক জাকির খান, মা গার্মেন্টস
মালিক বাবলু, দেবনাথ বস্ত্রালয়ের মালিক বিপ্লব দেবনাথ, সাহা বস্ত্রালয়ের
মালিক অমল সাহা, হাজী ফ্যাশন সুজ মালিক জাকির হাওলাদার, সাইফুল সু স্টোর
মালিক সাইফুল ইসলাম জানান, অন্য ঈদের সময় দোকানে অতিরিক্ত কর্মচারী রাখতে
হয়েছে। এ বছর জেলে পল্লীর মানুষদের দেখা মিলছে না বলে বিক্রি জমে উঠেনি।
জেলেদের দূর্দশা ও ভরা মৌসুমে ইলিশের দেখা না পাওয়ার বিষয়ে উপজেলা মৎস্য
কর্মকর্তা বিনয় রায় জানান, উপজেলায় ৭ হাজার ৯'শ ৯৭ জন তালিকাভুক্ত জেলে
রয়েছে। এদের মধ্যে ৪ হাজার ২৭ জন জেলে সরকারী সহযোগিতা পায় বাকিরা কষ্টে
থাকার কথাই বলবে। মাছ না পাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক কারনে হতে
পারে।
নিপুণ চন্দ্র, nipunch@gmail.com