-খুব ইচ্ছা করে দাদা, খু.. উ.. ব!
কিন্তু আমার ইচ্ছে করেনা রাহেলার ইচ্ছেগুলো ছুঁয়ে দেখি। ওর চোখের দু’ফোটা অশ্রু আমাকে মূল্যবান হীরের মতো আকর্ষণ করে। লোভী চোরাচানীর মতো অপেক্ষা করি না ঝরা জল টলমল চোখের ইচ্ছেগুলো স্পর্শ করার জন্য। কথাহীন মুখে কেবল অপেক্ষা করি তার পরবর্তী ইচ্ছেগুলো শোনার জন্য। রাহেলাও অনভিজ্ঞ চোখে পড়ে নেয় আমার ইচ্ছের ধারাপাত। আরো অপেক্ষায় থাকি ঘড়ি না দেখা সময়ের অনেকাংশ।
আনমনা হলে রাহেলার এক চোখের অশ্রু আড়াল হয় অন্ধকারে। হেরিকেনের হলুদ আলোয় আরেক চোখের অশ্রুরা রং বদলায়। তবু ঝরে পড়া না পড়ার মাঝখানে ঝুলে থাকে চোখের পাপড়িতে। আমি এক অনন্ত কাহিনীর অন্ধকারে ঢাকা পড়ে কথাহীন বসে থাকি সাদা কাগজ আর একটুকরো হলুদ আলোর নিচে। হেরিকেনের তেল নিঃশেষ হলে অন্ধকারের চাদরে ঢাকা পড়ে ওর দু’ফোটা হীরক অশ্রু।
-মনে হয় ভাইট্টল সোরতে ভাইস্যা ভাইস্যা দূরে পালাইয়া যাই।
পূর্ব-পশ্চিমে বয়ে যাওয়া সুরমার জল পূর্বাকাশে উঁকি দেয়া একাদশীর চাঁদের আলোয় চিক্চিক্ করে ওঠে। অন্ধকারেও টের পাই ওর চোখ রূপালি স্রোাতে স্থির হয়ে আছে।
ওপারে জামালগঞ্জ। নৌকার কারিগরের হাত থেকে ঝুরঝুর কওে খসে পড়ে ঝালাইয়ের আগুন।শুধু তাদেও হাতুরির আওয়াজ মাঝে মাঝে ধ্যান ভঙ্গ কওে রুপালি জল ও একাদশী রাত্রির। জ্যোৎস্না ক্রমেই অন্ধকার প্রকৃতির মধ্যে রহস্যময়তার জাল ছড়িয়ে দেয়। আমার লেখা হয়না রাহেলার কাহিনী। পকেটে কলম গুঁজে রাখি নিঃশব্দে। চোখ ফেরায় রাহেলা। করুণ ছলছল চোখে তাকায় আমার দিকে।
-এখন আমার আর কোনো ইচ্ছে নেই দাদা!
ওকে বলতে পারিনা কেনো তুই পালাতে চাস? আামর কি উচিত ছিল ওকে প্রতিবাদী হতে বলা? আর আমি সত্যি এটাও বুঝতে পারিনা রাহেলার তা করা উচিত কি না। প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকা সত্বেও কী এক ভয়ে মুষড়ে পড়ার মতো হয়ে যাই। যেনো ভয়ঙ্কও কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত নই আমি। কিন্তু নড়তে পারি না কিংবা ওর কাহিনী বলতে অনুরোধও করতে পারিনা।
-বাবা আমারে সকাল বইল্যা ডাকতো।
চমকে উঠি অন্ধকারে। ওর দিকে তাকাই।অবাক হই। নস্টালজিয়ায় বুদ হওয়া এই সুখী মুুখ এক মুহূর্ত আগে ছিল আমার কল্পনারও বাইরে। স্নিগ্ধ হাসিতে পরিপূর্ণ এই মুখ এই প্রথম দেখলাম যেনো। নাহ্ আরও একবার দেখেছিলাম। তবে তার অপরাধে ওর শাস্তি হয়েছিল ভীষণ।
-আমি চইল্যা যামু হেইডাও পারিনা।
-কেন?
-একদিন গাঙে আমাগো সব ঘরবাড়ি নিয়া গেলো। দুই রাইত, দুই দিন উপাস। বাবা আমারে এই ফুফুর বাড়িতে রাইখ্যা দশ হাজার টেকা নিয়া গেল।
-তারপর?
-শোধবার পারে নাই। তাই…
কথাটা শেষ না করলেও ওর মুখে একটা জীবন বিরুদ্ধ তিরস্কারের হাসি দেখে বুঝেছিলাম, তারপর কেন রাহেলা পালাতে পারেনি।
একাদশীর চাঁদ পশ্চিমাকাশের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে ইতোমধ্যে। ওর কাঁধের ডাকদিকে ওরনায় ঢেকে রাখা অত্যাচারের চিহ্ন ওর অজান্তেই চক্চক্ করে ওঠে জ্যোৎস্নায়। রাহেলার কাহিনী বা তৎসংক্রান্ত কোনো গল্প লেখার ইচ্ছে করেনা। ওর চোখে তাকাই, কোনো অশ্রু নেই।কষ্টের সবটুকু ভাগ করে কাউকে দিলে যে আত্মতৃপ্তি ওর চোখে শুধু তারই ছায়া।
আমার পকেটে রাখা সাদা কাগজে নৌকা বানিয়ে ভাটির স্রোতে ছেড়ে দেই। তখন মসজিদ থেকে ভেসে আসে –‘মুসলিম ভাই ও বোনেরা, উঠুন। সেহেরি খাওয়ার সময় হয়েছে…।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
মোমিন স্বপন, লেখক
 
Top