পৃথিবীর পথে হেঁটে
লেখক: অলকনন্দা প্যাটেল
৬৫০.০০ 
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন (বাংলাদেশ)
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক অলকনন্দা পটেলের(১৯৩৭-) এই পুঙ্খানুপুঙ্খ আর সীমাহীন ঐশ্বর্যে ভরা স্মৃতিকথা আমায় বীণার তারের মতো বাজিয়ে দিল। যেন চারপাশের এই মৃত্যুগন্ধী পরিবেশেযেখানে জ্ঞানচর্চা প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে পার্শ্বরেখায়িত হয়ে গিয়েছেআমি রামপুর ঘরানার অঙ্গে একটি বন্দিশ শুনছি। আমাদের কষ্টার্জিত আধুনিকতা আজ এক কানাগলির সামনে দাঁড়িয়ে। ফলে এই সংকটের সময় কী বই পড়ব সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আত্মতুষ্টির গা ঘিনঘিনে অনুভূতি থেকে নিষ্ক্রমণের অন্য কোনও রাস্তা নেই।
ক্রয় করুন http://www.bongshi.org থেকে
ঢাকার গেন্ডারিয়ায় ‘উমা কুটির’-এ এই বিদুষীর জন্মইডেন স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু। পিতা যশস্বী অর্থনীতিবিদ১৯২৬-৪৬ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (পরে দীর্ঘদিন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ও পটনাঅধ্যাপক অমিয়কুমার দাশগুপ্তঅশোক মিত্রের ভাষায় যাঁর ‘পাণ্ডিত্যের গাম্ভীর্য এবং ছাত্রবৎসলতা প্রবাদে পরিণত হয়েছিল।’ অলকনন্দা পরে বেনারস ও হার্ভার্ডে শিক্ষাগ্রহণ করেনদিল্লি ও লন্ডনে অধ্যাপনা করেছেনইতালিতে একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেনকিন্তু ১৯৪৬-এর ২ অক্টোবর গেন্ডারিয়ার বাড়ি থেকে চিরদিনের মতো ঢাকা ছাড়লেও গৈলাবরিশালঢাকার স্মৃতি তাঁকে ছাড়েনি। পরবর্তী জীবনে বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে তির বেঁধার মতো যুক্ত হয়ে যায় ৫ নং পুরানা পল্টনে শৈশবের বিশদবিক্ষিপ্ত চিত্রমালা আর এই খণ্ডিত বাংলায় ইতিহাস হারানোর যন্ত্রণা।
এই আদ্যন্ত বাঙালি আত্মকথাটি পড়তে পড়তে স্মৃতিলিখনের কঠিন শিল্প সম্পর্কে স্যামুয়েল জনসনের কথা মনে পড়ল: ‘দ্য ট্রু আর্ট অব মেমরি ইজ দি আর্ট অব অ্যাটেনশন। শুরুতেই জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’-র একটি কবিতাংশ: ‘খুঁজে তারে মর মিছে— পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;/... সেই সব ভিজে ধুলোবেলকুঁড়ি-ছাওয়া পথ,— ধোঁয়া-ওঠা ভাত,/ কোথায় গিয়েছে সব?’ পরিব্যাপ্ত জীবনের হারিয়ে যাওয়া খুঁটিনাটি— যা এক বিদগ্ধ পরিবারের বালিকার চোখে নীলক্ষেতের হাতছানির মতো সজীব ও বাঙ্ময়— এই বইকে দিয়েছে তার অনুভূতি ও স্মৃতির কাঠামো।
কালি ও কলম’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ঢাকার স্মৃতি’ পড়ে অশোক মিত্রই অলকনন্দাকে বলেন ‘মনের আনাচে-কানাচে আরও খোঁজ নিয়ে’ বইয়ের আকারে ঢাকার ‘জীবনশৈলী’ লিখতে। তাঁকে সাহায্য করেছে মায়ের চিঠির ঝাঁপি আর ডায়েরি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধদুর্ভিক্ষদাঙ্গা আর স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে বড় হওয়া অলকনন্দার ভাষায়, ‘আনন্দ-আতঙ্ক দুইই পাশাপাশি ছিলআমরা ছোটরা কিন্তু আনন্দ নিয়েই থেকেছিমন থেকে আতঙ্ক মুছে ফেলতে সময় লাগেনি।’ আতঙ্কের প্রতিরোধ হিসাবে আনন্দই এই গ্রন্থের নির্যাস।
বুদ্ধদেব বসুর ‘আমার শৈশব’ বা ‘আমার যৌবন’-এ পুরনো ঢাকার স্বাদু স্মৃতি আছে। লেখিকা পরিমল রায়কে লেখা বুদ্ধদেবের চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন: ‘পল্টনের মাঠের মতো সুন্দর পৃথিবীর অন্য কোন মাঠ আমাদের চোখে লাগবে না।... মনে হয় অনেক কথাই বলা হয়নিসেখানকার দিনরাত্রিবিকেলসন্ধ্যাস্তব্ধ মধ্যরাত্রির আশ্চর্য নীল সিনেমার মতো জোছনাতার সুরটি স্পর্শটি আবার নতুন করে ধরতে ইচ্ছে করে।’ এই বই সেই সুরটির সাত রঙের বিস্তারকে ছুঁয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত পরিবেশের ছবি বিন্দু বিন্দু তুলিস্পর্শে ফুটে উঠেছে ৫ নং পুরানা পল্টনের দোলনচাঁপামাধবীলতাচন্দ্রমল্লিকাজুঁইকাঞ্চনকে ঘিরে। ঘরের স্থাপত্যকাঠের ব্যাঙ দিয়ে বন্ধ করা দরজা-জানালাগোছানোপরিচ্ছন্ন ঘরসাজানোর জন্য শখের জিনিস বিশেষ ছিল নাবড়জোর হাতের কাজ বা লেসে তৈরি টেবিলের কভার। ‘মধ্যবিত্ত পরিবারের ভূষণ ছিল বই— আলমারি ভরা বই।’ যা আজ ছদ্ম-বিশ্বায়িত বাঙালির ঘরে ভীতিপ্রদ ভাবে কমে আসছে।
খুঁটিনাটির বর্ণনা নকশি কাঁথার মতো। চেজারে পাভেসে লিখেছেন, ‘আমাদের স্মৃতি তো কোনও দিনের নয়মুহূর্তের।’ কুয়ো থেকে জল তোলাকয়লা ভাঙাগুল দেওয়াদুই কাঁধে বাঁশে ঝোলানো হাঁড়িতে দুধঘিগুড় ফেরিওলাপায়ে চটিসাদা শাড়ি ও চশমা পরাগ্র্যাজুয়েট’ ভিখারিনিউঠোনে পুরনো ধুতি গায়ে জড়িয়ে বাবার চুল কাটাঝামা দিয়ে পা পরিষ্কার করে আলতা পরালেখিকার বিনুনিমায়ের খোঁপাসাপলুডোয় নরকে নেমে যাওয়ার ভয়লালপাড় শাড়িচুড়িকঙ্কণআর্মলেটগলায় চিক ও একাধিক চেনকানে ঝুমকো সেজমাপ্রতিমা বরণের ‘করিয়াল’ শাড়ি।  
মা-মাসিদের সহজে কাপড় দিয়ে দুদিক ধরে ঢাকনি একটু খুলে ভাতের ফেন বার করা থেকে রান্নাঘরের অধুনালুপ্ত ‘মিটসেফ’, অসুখের সময় আদা-তুলসী শিউলি পাতার রসদুধ-সাবুবার্লির জলডায়মন্ডের মতো কাগজ কেটে মিক্সচারের শিশির দাগঅসুখ শেষে ফুরফুরে ‘কালিজিরা’ চালের ভাত। পরে একদিন বস্টন শহরে বাংলাদেশি দোকানে ‘কালিজিরা চাল’ দেখে তাঁর পুরনো স্মৃতি মনে পড়েছে। গয়নাগাঁটিরান্না ভাঁড়ারের বিবরণ পড়ে অনেকের কল্যাণী দত্তের থোড় বড়ি খাড়া-র কথা মনে পড়বে। কিন্তু এ বইয়ের পরিসর দেশ কাল ছুঁয়ে ইতিহাসকে ধারণ করে আছে।
ক্রয় করুন http://www.bongshi.org থেকে
জীবন ছিল সাদামাটা। খেলনাসাজগোজবইপত্র কিছুরই প্রাচুর্য ছিল না। ফলে সাধারণ পোশাক-আশাকখাদ্যবস্তুএমনকী ট্যালকম পাউডার (যার কৌটোর ফুটো ফুটো মুখ এক দিকে প্যাঁচ দিলে খোলে!জীবনে সুগন্ধ এনে দিত। সেই যুগে বইখাতার ভারটিউশন ছিল নাসহজ শিক্ষা। লেখিকা গ্লোব দেখে পড়াশোনা করার সময় দাদা অমর্ত্য সেনও তাঁকে ভয় পেতেন, কারণ ‘টিম্বাকটু’ চিনবার খেলায় তিনি তাঁকে হারিয়ে দিতেন!    
বইটির সম্পদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণনা। যেমন ধরা যাক, পরিমল রায়ের উদ্ধৃতি: ‘সেকালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রমনার সাত সমুদ্র ছড়াইয়া ছিল।... আমরা নতুন আগন্তুকেরা দিশাহারা আত্মহারা হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। যাহা দেখিতাহাতেই মুগ্ধ হইয়া যাই।... উনি কেসত্যেন বসু।... উনিডা জ্ঞান ঘোষ। ইনিডা রমেশ মজুমদার। আর উনিডা সুশীল দেইংরাজি ও সংস্কৃতের প্রতিভা। বিদ্যার বিপণিতে যেন হালখাতার উৎসব। চতুর্দিকে একটা নেশাধরা আমন্ত্রণ।’ সত্যেন বসুআব্দুর রাজ্জাকজসীমউদ্‌দীনমোহিতলালমুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের বিশ্ববিদ্যালয় উপমহাদেশে যে স্বতন্ত্র দিশা দেখিয়েছিল ‘আমিত্ব’ বর্জন ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। বুদ্ধদেব বসুঅশোক মিত্রভবতোষ দত্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্তান।
পিতা ও অন্যদের ‘ক্ষুব্ধ ও নিরাশ’ ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার বিবরণ আছে। সাম্প্রদায়িকতার অনিষ্টকরমনগড়া বিধান নিয়েও ছোট মেয়েটির চিন্তার অন্ত ছিল না। রাজনীতিকে সে এড়িয়ে যায়নি। সুস্থ শিক্ষিত মনের এই বিকাশ এক অপূর্ব লাবণ্য ও সুষমার জন্ম দিয়েছে।   
ঢাকা ছাড়ার পর ভারতবর্ষে ও বহির্বিশ্বে শিকড় খুঁজে পেয়েছেন। বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিয়েছেন রামপুর ঘরানায়রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন শৈলজানন্দ মজুমদারের কাছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুবাস্তুহারা মানুষের ছায়া খানিকটা সরে গিয়েছে। পুরনো ঢাকার অনেক বদল হয়েছে। ‘সেই ঢাকা’ আর নেই। কিন্তু লেখিকার মনে সুরের রেশ অব্যাহত আছে।
অলকনন্দা যখন তাঁর স্মৃতি পুনর্নির্মাণের শেষে লেখেন, ‘আমি ভারতীয়, আমি বাঙালি, আমি দুই বাংলার বাঙালি, গৈলা আমার দেশ, ঢাকা আমার বাড়ি...। তবু মনে হয়, বারবার মনে হয়, এই ভাগ-বাটোয়ারা, এই সীমান্তরেখা না হলেও তো পারত।’ বইয়ের স্নায়ু থেকে একটি রক্তরেখা চুঁইয়ে পড়ে। 
 
Top