ইসলামের নামে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদকে ‘হারাম’ আখ্যায়িত করেছেন লক্ষাধিক মুফতি ও আলেম-ওলামা। জঙ্গিদের জানাজা পড়াও হারাম বলে মত দেয়ার পাশাপাশি তারা বলছেন, যারা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মারা যাবেন তারা শহীদের মর্যাদা পাবেন।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আলেমদের এই ‘ফতোয়া’ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান ও শোলাকিয়ার ঈদ জামাতের ইমাম মওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ।
গত দেড় বছরজুড়ে লেখক, প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, অধ্যাপক, বিদেশি, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান যাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষুর ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে একই কায়দায় হামলার প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের কাছ থেকে এ মত পাওয়া গেল।
সংবাদ সম্মেলনে মওলানা মাসঊদ বলেন, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলামের নাম ব্যবহার করে কতিপয় সন্ত্রাসীগোষ্ঠী নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে মহাগ্রন্থ কোরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাস ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মানুষের চোখে ইসলামকে একটা বর্বর-নিষ্ঠুর ও সন্ত্রাসী ধর্মরূপে চিত্রিত করছে। এতে সরলমনা কেউ কেউ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন।
জঙ্গিদের অনেকেই ‘জিহাদি’ বললেও তারা আসলে ‘সন্ত্রাসী’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইসলাম সন্ত্রাস সমর্থন করে না। আর যারা বেহেশত পাওয়ার আশায় আত্মঘাতী হামলা করছে, বলছে মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি, তারা কোরআন ও হাদিসের আলোকে বেহেশত পাবে না। তাদের স্থান নিশ্চিত দোজখে।’ ‘এমনকি ধর্মের নামে সন্ত্রাসকারী, জঙ্গি, গুপ্ত হত্যাকারীদের জানাজার নামাজ পড়াও হারাম। আর যারা এই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মারা যাবে তারাই শহীদ হবেন।’ মওলানা মাসঊদ জানান, ‘বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার’ উদ্যোগে বাংলাদেশের এক লাখ এক হাজার ৫২৪ জন মুফতি, আলেম-ওলামা এই ‘ফতোয়া’য় দস্তখত করেছেন। বিভাগীয় শহরগুলোর নামে ২৬টি এবং শুধু নারী আলেমদের স্বাক্ষরে ‘ফতোয়া’র চারটি খ- তৈরি হয়েছে।
সব খ-েই জঙ্গিবাদ নিয়ে মূল ফতোয়ার সঙ্গে দারুল উলুম দেওবন্দ, মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, চরমোনাই জামিয়া রশিদিয়া ইসলামিয়া, শায়খ জাকারিয়া রিসার্চ সেন্টার ও জামিয়াতুল আসআদ মাদ্রাসাসহ হেফাজতের ইসলামের নেতাদের ফতোয়াও সংযুক্ত করা হয়েছে।
ফরিদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে দস্তখত সংগ্রহ কমিটিতে ছিলেন সদস্যসচিব আবদুর রহিম কাসেমী, যুগ্ম সদস্যসচিব সদরুদ্দীন মাকুনুন, সদস্য আল্লামা আলীম উদ্দীন দুর্লভপুরী, হোসাইন আহমদ, দেলোয়ার হোসাইন সাঈফী, ইমদাদুল্লাহ কাসেমী, আইয়ুব আনসারী, ইবরাহিম শিলাস্থানী, আবদুল কাইয়ুম খান, যাকারিয়া নোমান ফয়জী।
ফতোয়ায় ১০টি প্রশ্ন রয়েছে।
১. মহান শান্তির ধর্ম ইসলাম কি সন্ত্রাস ও আতঙ্কবাদী কর্মকা-কে সমর্থন করে?
২. নবী ও রাসুল বিশেষ করে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি এই ধরনের হিংস্র ও বর্বর পথ অবলম্বন করে ইসলাম কায়েম করেছেন?
৩. ইসলামে জিহাদ ও সন্ত্রাস কি একই জিনিস?
৪. সন্ত্রাস সৃষ্টির পথ কি বেহেশত লাভের পথ না জাহান্নামের পথ?
৫. আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর মৃত্যু কি শহীদি মৃত্যু বলে গণ্য হবে?
৬. ইসলামের দৃষ্টিতে গণহত্যা কি বৈধ?
৭. শিশু, নারী, বৃদ্ধ-নির্বিশেষে নির্বিচার হত্যাকা- ইসলাম কি সমর্থন করে?
৮. ইবাদতরত মানুষকে হত্যা করা কী ধরনের অপরাধ?
৯. অমুসলিমদের উপাসনালয় যথা গির্জা, মন্দির, প্যাগোডা ইত্যাদিতে হামলা করা কি বৈধ?
১০. সন্ত্রাসী ও আতঙ্কবাদীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইসলামের দৃষ্টিতে সবার কর্তব্য কি না?
তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, ‘জিহাদ ও সন্ত্রাস একই জিনিস নয়। জিহাদ হলো ইসলামের অন্যতম একটা নির্দেশ, পক্ষান্তরে সন্ত্রাস হলো হারাম ও অবৈধ।’
চতুর্থ প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, ‘যারা বেহেশত লাভের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন, তারা জাহান্নামের এই পথ ছেড়ে দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করে শান্তি ও হেদায়েতের পথে ফিরে আসতে হবে।’
পঞ্চম প্রশ্নের উত্তরে ‘আত্মহত্যা ও আত্মঘাতী হামলা ইসলামের দৃষ্টিতে “হারাম” বলা হয়েছে।’
নবম প্রশ্নের উত্তরে বলা আছে, ‘মুসলিম সমাজে বসবাসকারী অমুসলিমকে যদি কেউ হত্যা করে সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না। অমুসলিমদের গির্জা, প্যাগোডা, মন্দির ইত্যাদি উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম ও অবৈধ। এটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
‘সংযুক্ত প্রত্যেকটি ফতোয়াতেই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে কোরআন ও হাদিসের আলোকে হারাম বলা হয়েছে’, বলেন মওলানা মাসঊদ।
জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের ‘হৃদয়বৈকল্য’ দূর করা না গেলে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এদের দমন করা সম্ভব নয় বলে মত দেন তিনি।
‘এই সন্ত্রাসীরা তো ধর্মের নামে আত্মদানে প্রস্তুত। তাদেও চৈতন্যের বিভ্রম দূর করা দরকার সবার আগে। ইসলামের সঠিক ও বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা তুলে ধরে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষে তা করা সম্ভব।’
‘ফতোয়া’র মূল অংশ পুস্তক আকারে প্রকাশ করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে দেশের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, গত ৩ জানুয়ারি থেকে আলেমদের স্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়। গত ৩১ মে শেষ হয়। গত ১৭ ডিসেম্বর আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে পুলিশ সদর দপ্তরে ধর্মীয় নেতাদের একটি সভা হয়। ওই সভায় এ স্বাক্ষর গ্রহণের প্রস্তাব তুলে ধরার পর তা সভায় সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। এরপর এ বিষয়ে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারা সারাদেশের আলেমদের কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে।
সংবাদ সম্মেলনে খতিব বলেন, ‘ফতোয়ায় কি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ঠেকানো যাবে? এ প্রশ্ন উঠতে পারে। আমরা দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই, অস্ত্রের চেয়ে ফতোয়ার শক্তি অনেক ধারালো। মনঃচেতনা মানবকর্মের মূল উৎস। সঠিক ফতোয়া সেই মনঃচেতনাকে শুদ্ধ করে আলোড়িত করে।’
স্বাক্ষর অভিযান সংগ্রহে নামতে গিয়ে তিন শ্রেণি থেকে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ। বাধাদানকারীরা হচ্ছে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিবাদীগোষ্ঠী, জঙ্গি হামলার শিকার হওয়ার আতঙ্কে দস্তখত না করা এক শ্রেণি ও আরেকটি হচ্ছে হিংসুক শ্রেণি। এ ছাড়া অনেক স্থানে বিরূপ সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাদের।
কিন্তু মানবকল্যাণ ও শান্তির জন্য এ ফতোয়া প্রচারে দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, সরকার ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘আমাদের দেশে কত আলেম আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। তারপরও ধারণা করা হয়, ১৫ হাজার কওমি মাদ্রাসা, পাঁচ হাজার আলিয়া মাদ্রাসা, এক লাখ মসজিদের ইমামসহ পাঁচ লাখের মতো আলেম থাকতে পারেন। তাদের মধ্য থেকে প্রসিদ্ধ আলেমদের কাছ থেকে এই স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়েছে।’
ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ দাবি করেন, জঙ্গিবাদী ছাড়া বাকি সব আলেমের প্রতিনিধিত্ব করছে জমিয়তুল উলামা। ফতোয়া কার্যকরের কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফতোয়া হচ্ছে এ-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত। তারা এটা কার্যকর করার অধিকার রাখেন না। তারা কেবল বার্তাবাহক। বাংলাদেশের মুসলিম-সমাজে ফতোয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। এটা জঙ্গিবাদীদের ওপর একটি নৈতিক চাপ তৈরি করবে। তাদের মানসিক শক্তি ভেঙে পড়বে।
ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘জঙ্গিবাদীদের মনোবৈকল্য দূর করা ফতোয়া প্রকাশের উদ্দেশ্য। সন্ত্রাস ও জিহাদ যে এক জিনিস নয়, তা পবিত্র কোরআন, হাদিসের আলোকে যুক্তি দিয়ে তুলে ধরার উদ্দেশে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। এখন আমাদের কর্তব্য হলো এসব দেখেশুনেও বোবা হয়ে শয়তানের মতো দাঁড়িয়ে না থাকা। জঙ্গিবাদী প্রতিরোধে পারলে হাতে, নইলে মুখে, আর একেবারে না পারলে অন্তর থেকে ঘৃণা করা।’
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন স্বাক্ষর সংগ্রহ কমিটির সদস্য মওলানা দেলওয়ার হোসেন সাইফী, মওলানা আবদুর রহিম কাশেমী প্রমুখ।