বিশ্ব তোলপাড় করা অর্থ পাচার-সম্পর্কিত পানামা পেপারসে আসা নামের মধ্যে ৪৩ বাংলাদেশী শনাক্ত হয়েছে। এদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী।
ধারণা করা হচ্ছে, তারা দেশ থেকে বিরাট অংকের অর্থ পাচার করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট
(বিএফআইইউ) এদের প্রকৃত পরিচয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক হিসাব চিহ্নিত করা হয়েছে ৩৯ ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের।

পাশাপাশি অর্থ পাচারে অভিযুক্ত এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন এবং বৈদেশিক বাণিজ্য-সম্পর্কিত তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
সূত্র মতে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরধারীর পাশাপাশি আগের লেনদেন তদন্ত করতে ৬টি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব কমিটি পানামা পেপারসে আসা ব্যক্তিদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও আয়কর-সম্পর্কিত তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে।
পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ বিল অব এন্ট্রি এবং রফতানি মূল্য অপ্রত্যাবাসিত আছে কিনা, তা জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার কাছে তথ্য চেয়েছে তদন্ত কমিটি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থপ্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, পানামা পেপারসে আসা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। যদি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার হবে। এক্ষেত্রে ছাড় দেয়ার কোনো প্রশ্ন উঠে না।
তবে বিএফআইইউ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব নিয়ে প্রতিদিন পর্যালোচনা, বিচার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আর এসব ব্যক্তির নামের তালিকা ও ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কনসোটিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) এর ওয়েবসাইট থেকে। এরপর নাম-ঠিকানা নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। যাচাই-বাছাই শেষে অস্তিত্ব ও সত্যতার ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা হয়েছে তালিকা।
জানা গেছে, সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পানাম পেপার্সে আসা বাংলাদেশীদের নামের তালিকাসহ একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে নিদের্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে।
উল্লেখ্য, জার্মান পত্রিকা জিটডয়েচ সাইতং ও ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) মোসাক ফনসেকার প্রায় দেড় কোটি নথি প্রকাশ করে। ফাঁস হওয়া এসব গোপন নথিপত্র ‘পানামা পেপারস’ নামে অভিহিত করা হয়।
বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ ক্ষমতাধর সব রাজনীতিবিদ রয়েছেন এ তালিকায়। রয়েছেন কয়েকজন স্বৈরশাসকও। এ নথি ফাঁসের পর তাদের গোমর ফাঁস হয়ে যায়।
এসব প্রভাবশালীদের সম্পদ আড়াল, ট্যাক্স ফাঁকি আর অর্থ পাচার বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামও। যারা বিভিন্ন অফসোর কোম্পানির নামে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন বলে পানামা পেপারসে বলা হয়েছে, তালিকায় আছেন- আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ, তার স্ত্রী নিলুফার জাফর এমপি ও তার পরিবার, সামিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড মার্কেন্টাইল কর্পোরেশন প্রাইভেটের চেয়ারম্যান আজিজ খান, তার স্ত্রী আঞ্জুমান আজিজ খান, কন্যা আয়েশা আজিজ খান, চেয়ারম্যানের ভাই জাফর উমেদ খান, আজিজ খানের ভাজিতা মো. ফয়সল করিম খান।
নামের তালিকায় আছেন ইউনাইটেড গ্রুপের হাসান মাহমুদ রাজা, খন্দকার মইনুল আহসান (শামীম), আহমেদ ইসমাইল হোসেন ও আখতার মাহমুদ। এতে নাম আছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি এএমএম খান, মোমিন টি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজমল মইন, পাট ব্যবসায়ী দিলিপ কুমার মোদি, সি পার্ল লাইন্সের চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ সিরাজুল হক, বাংলা ট্রাক লিমিটেডের মো. আমিনুল হক, নাজিম আসাদুল হক ও তারিক একরামুল হক, ওয়েস্টার্ন মেরিনের পরিচালক সোহেল হাসান, মাসকট গ্রুপের চেয়ারম্যান এফএম জুবাইদুল হক শেতু কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাবুদ্দিন চৌধুরী, স্কার্ফ এবং অমনিকেম লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখারুল আলম, তার পুত্রবধূ ফওজিয়া, আবদুল।
এছাড়া মোনেম লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম মহিউদ্দিন আহমেদ, তার স্ত্রী আসমা মোনেম, অনন্ত গ্রুপের শরিফ জাহির। নথিতে বাংলাদেশের অন্যরা হচ্ছেন- এএফএম রহমাতুল্লাহ বারী, ক্যাপ্টেন এমএ জাউল, সালমা হক, কাজী রায়হান জাফর, মির্জা এম ইয়াহ ইয়া, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, সৈয়দা সামিনা মির্জা ও জুলফিকার হায়দার। এছাড়া বিবিটিএল নামে নতুন একটি কোম্পানির নামও জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, পানামা পেপারসে আসা ব্যক্তিদের ব্যাপারে অনুসন্ধান কমিটি কয়েকটি ইস্যু নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। বিশেষ এসব ব্যক্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রয়েছে। এজন্য আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি ট্যাক্স হেভেন হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর সঙ্গে এসব ব্যক্তির বহির্বাণিজ্য সম্পৃক্ততাও দেখা হচ্ছে।
এছাড়া এসব দেশের বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য করছে কিনা, তাও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। জানা গেছে, তদন্তের স্বার্থে এসব বিষয়ে জাতীয় এনবিআরের কাছে তথ্য চেয়েছে অনুসন্ধান কমিটি।
এছাড়া অর্থ পাচারে অভিযুক্ত ৪৩ ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মেয়াদোর্ত্তীণ বিল অব এন্ট্রি এবং রফতানি মূল্য অপ্রত্যাবাসিত আছে কিনা, তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
তদন্ত কমিটির এক সদস্য বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প বৃহৎ। তাদের এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ বিপুল। ফলে এসব লেনদেন পর্যালোচনা ও সংগ্রহ করতে সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে।
 
Top