বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে যখন বেরলামসূর্যের অবস্থান তখন সোজাসুজি মাথার উপর স্যামুয়েল লেপচা পার্কিংয়ে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল তাতে চেপেই এগিয়ে চললাম সিকিমের অচিন গ্রামের উদ্দেশে
দিনের আলো তখন প্রায় নিভু নিভু রানিপুল থেকে গ্যাংটকগামী রাস্তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চললাম পাকইয়ং-এর দিকে বাগডোগরা থেকে ১২৩ কিলোমিটারের লম্বা যাত্রাপথের পর পাকইয়ং বাজার ছাড়িয়ে গাড়ি এসে থামল নারায়ণ প্রধানের বাড়ির দোরগোড়ায়
সিকিমের বিভিন্ন প্রান্তে পর্যটন প্রসারে নারায়ণ প্রধান এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন তিনি তাঁর বন্ধু হৃষিকেশ গুরুংয়ের আমন্ত্রণে নারায়ণের বাড়িতে সান্ধ্য চায়ের আসরে হাজির হলাম ১০৪ বছরের পুরনো সাবেক বাড়িটি বর্তমানে ‘অ্যালপাইন হোম স্টে আসবাবপত্রঅন্দরসজ্জায় আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট
পাকইয়ংস্থানীয় উচ্চারণে ‘পাক্ষিম’ কথার অর্থ ‘ল্যান্ড অব হ্যাপিনেস সুখের এই স্থান ছেড়ে বার এগিয়ে চললাম কিলোমিটার দূরে ইয়াকতেনের পথে পাকইয়ং-এর পর এই রাস্তাটা বেশ নিরিবিলিশুনশান সন্ধ্যাতেই সমগ্র অঞ্চলটা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে ইয়াকতেন গ্রামে যখন পৌঁছলাম ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় রাত ৮টা এখানে ‘অর্কিড হোম স্টে’ দুরাতের অস্থায়ী ঠিকানা প্রবেশপথের মুখে স্বাগত জানাতে বরণডালা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জ্ঞান বাহাদুর সুব্বা তাঁর স্ত্রী বাসন্তী স্থানীয় প্রথা আনুযায়ীখাদা পরিয়েকপালে টিকা লাগিয়ে অতিথিবরণ পর্ব মিটল
নারায়ণ বলেছিলেনস্থানীয় ভাষায় ইয়াকতেন কথার অর্থ ‘ওয়েলকাম টু মাই নিউ হোম একেবারে ‘নিউ হোম’ না হলেও আধুনিক সরঞ্জাম ঝকঝকে আসবাবে ছিমছাম গোছানো ঘরখানায় নতুনত্বের গন্ধ ছড়িয়ে আছে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম দূরের পাকইয়ং- আলো ঝলমল করছে
বাসন্তী ডাকতে এলেনউপরের লনে ক্যাম্পফায়ার বার-বি-কিউ-এর আয়োজন সম্পূর্ণ দিনের বেলায় শীত মালুম হয়নি এখন ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আগুনের পাশে এসে বসলাম গ্রামের মেয়েরা ট্র্যাডিশনাল পোশাকে সেজেগুজে তৈরি ঘরোয়া জলসায় স্থানীয় ভাষায় নৃত্য-গীত পরিবেশন শুরু হল ঝলসানো চিকেনের সঙ্গে হাজির হল অরগ্যানিক মিলেট ওয়াইন ‘ছাং’, পোশাকি নাম ‘টোংবা বাঁশের পাত্রে পরিবেশিত পানীয়টির উপরিভাগে মিলেটের স্তর বাঁশের স্ট্র সহযোগে পান করাই হল প্রথা
সান্ধ্য-আসর শেষে ডিনার পর্ব বাসন্তীর হাতের গুণে ডালআলুভাজারুটিচিকেন কারির স্বাদ হয়েছে অতুলনীয় যত রাত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে শীতের পারদও নামছে সারা দিনের ক্লান্তিতে কম্বলের আরামে তলিয়ে গেলাম ঘুমের অতলে
সফরসূচি অনুযায়ীভোরবেলা আড়াই কিলোমিটার আরণ্যক পথ ধরে পায়ে হেঁটে যাওয়া হবে ঝান্ডিদাঁড়া ঝান্ডিদাঁড়া থেকেই দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ আরও অনেক তুষারধবলশৃঙ্গ সেই মতোতৈরি হয়ে বাইরে এসে দেখি কপাল মন্দ পাহাড়ের মাথাগুলি মেঘের ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকিয়েছে সুতরাংঝান্ডিদাঁড়া গিয়ে কোনও লাভ হবে না কাছেই একটু উপরে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে ক্ষীণ আশা নিয়ে সেই পর্যন্ত গিয়ে কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করলামযদি কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলে কিন্তুঘোমটা সরিয়ে হিমানীশৃঙ্গ মুখ দেখাল না
সকালের প্রাতরাশ সেরে তৈরি হয়ে বেলা ১১টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম পাস্তাঙ্গার পথে কিলোমিটার চলার পর স্যামুয়েল গাড়ি থামাল এয়ারপোর্ট ভিউ পয়েন্টএখান থেকেই দেখা যায় সিকিমের নির্মীয়মান এয়ারপোর্টের বিরাট রানওয়ে নেপথ্যে পাকইয়ং-এর দৃশ্য পাইনের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় জনপদঘনসন্নিবদ্ধ ঘরবাড়িস্কুলসবুজ ঘাসে ঢাকা দৃষ্টিনন্দন উপত্যকা সিকিমবাসীদের আশাহয়তো বছরই চালু হবে উড়ান
আরও কিলোমিটার চলার পর পাকইয়ং বাজার এখান থেকে ডান দিকের রাস্তা গেছে আসামলিংজের দিকে সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম দূরে পাহাড়ের মাথায় দেখা যায় ছাঙ্গে মনাস্ট্রিআর এক দিকে দেওরালি পাকইয়ং বাজার থেকে ১৩ কিলোমিটার চলার পর একটি সরকারি নার্সারি পেরিয়ে পৌঁছলাম গৈরীগাঁও
গৈরী’ কথার অর্থ নীচে উচ্চতাও বেশি নয়৪৫০০ফুট ‘পাস্তাঙ্গা’ অঞ্চলের মধ্যেই গৈরীগাঁও-এর অবস্থান পল রাই তাঁর ‘মালিঙ্গো হোম স্টে’-তে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন ‘মকাই কা চুরা’ (ভুট্টা থেকে তৈরি একপ্রকার স্ন্যাক্স)  ‘টোংবা’ সহযোগে আপ্যায়নের পর পলের কাছ থেকে জানতে পারলাম এই অঞ্চলের অনেক তথ্য ‘পাস্তাঙ্গা’ শব্দের অর্থ ‘অনেক পাথর একসময় এখানে জঙ্গল ছিল আগে নাম ছিল ‘পাসিংতেল’, উচ্চারণভেদে ‘পাস্তাঙ্গা’ (ভুটিয়া ভাষায়) নেপালি সম্প্রদায়ের মধ্যে রাইলিম্বুছেত্রিবাহুনসুনুয়ারবুজেলমঙ্গরশেরপাতামাং, প্রধানত এদেরই বাস বড় এলাচভুট্টামিলেট আদা চাষ প্রধান কৃষিকাজ ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে ডেয়ারি শিল্প
এখান থেকে কাছে-দূরে বেশ কিছু দ্রষ্টব্য আছে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরেই তাক্চাম চু সেখানে আসালা ট্রাউট মাছ পাওয়া যায় আবার / ঘণ্টা জঙ্গলের পথে ট্রেক করে পৌঁছনো যায় ৭০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ‘ডুঙ্গেল খরকা সরলকোণে দেখা দেয় বরফে মোড়া গিরিচূড়া
পলকে বিদায় জানিয়ে ১২ কিলোমিটার দূরে আসামলিংজে পৌঁছলাম প্রায় ৩টে নাগাদ বালাখোলাটক্চেন খোলাসেলেলে খোলাতিনটি ঝর্নার স্থান ‘আচ্ছাম’ (লেপচা ভাষায় আসাম) আর ‘লিংজে’ মানে ‘চাষের খেত এখানে ইয়াকচেরি হোম স্টে-তে বিক্রম সুব্বা মন বাহাদুর সুব্বার আতিথ্যে দুপুরের আহার সমাধা করে গ্রাম দেখতে বেরলাম
বাড়ির ছাদ থেকেই দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা নিজেদের জমিতেই নানা প্রকার ফুল সব্জির চাষ হয়েছে কাছেই একটি অর্কিড সেন্টার মেডিটেশন সেন্টার আছে পর্যটকদের জন্য নানান বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে যেমনআসামলিংজে থেকে সারমাসা গার্ডেন পর্যন্ত প্যারাগ্লাইডিং হয়আবার তাক্চাম নদীতে ফিশিংয়ের ব্যবস্থাও করা হয়

ইয়াকতেনে ফিরে এলাম সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ পরদিন সকালটা পাহাড়ি পথে অলস পায়চারি জ্ঞান বাহাদুরের নার্সারির বাহারি ফুলের সম্ভার দেখেই সময় কেটে গেল দুপুরের আহার সেরে সুব্বা পরিবারকে বিদায় জানিয়ে দুপুর ১টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্য ছোচেনফেরির উদ্দেশে পথের ধারে কমলা রঙের থোকা থোকা ফুল ছেয়ে আছেনাম সুস্তানি স্যামুয়েল জানালএই ফুল পুজোয় লাগে
পাকইয়ং বাজার পেরিয়ে মূল সড়ক ছেড়ে ছোচেনফেরি যাওয়ার আলাদা রাস্তা ধরলাম গোলাপী রঙের আরু ফুলের গাছের সারি পথের শোভা বাড়িয়ে তোলে পারাখারিকিপ প্রভৃতি জনপদ পার হয়ে বিকেল ৪টে নাগাদ পৌঁছলাম ছোচেনফেরি
রাস্তা থেকেই দেখা যায় নীচে খটখটে শুকনো লেক পাহাড়ি ঢালের ধাপ নেমে গেছে লেকের কাছ পর্যন্তঅনবদ্য ল্যান্ডস্কেপ গাড়ি থেকে নেমে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে পৌঁছলাম লেকের কাছে শুকনো লেকে বড় বড় ঘাসগাছপালা গজিয়ে গেছে বর্ষায় লেকটা জলে ভরে যায় চারপাশে ঘিরে আছে প্রার্থনা পতাকা ‘ছোচেন’ মানে ধর্মীয় আর এই জলাশয়টি ধর্মীয় বলেই মানা হয় পাহাড়ের অনেকটা উপরে আছে বৌদ্ধ গুম্ফা লেকের ধারে ‘ছোচেনফেরি ইকো হাট’-এর অবস্থানগত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আজ এখানেই রাত্রিবাস

৪০০০ ফুট উচ্চতায় ছোচেন ফেরি দুটি পাশাপাশি জায়গা নিয়ে ছোচেনফেরি গ্রাম প্রায় ১৭০-১৮০ পরিবারের বাস মূলত ভুটিয়াদের গ্রাম ১০০ বছরের পুরনো ভুটিয়া বাড়িগুলি অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে পাহাড়ের ধাপে গমধানমটরসর্ষেআলুবাঁধাকপিবড় এলাচমিলেট ভুট্টার চাষ হয়েছে গ্রামের ছেলেমেয়েরা ‘আর্চারি’ চর্চায় ব্যস্ত পরিবেশ বড়ই শান্ত
ছোচেনফেরি ইকো হাট’ আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত আরামের সব উপকরণই মজুত আছে সন্ধ্যায় স্থানীয় কিশোর-কিশোরীরা ভুটিয়া নৃত্য-গীতে মাতিয়ে দিল রাই-শাকের পকোড়া আর গুরাস (রডোডেনড্রন) থেকে তৈরি উপাদেয় পানীয় সহযোগে সন্ধ্যাটুকু জমে গেল তবে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা গেল নাঠান্ডা কামড় বসাচ্ছে তাড়াতাড়ি রাতের আহারটুকু সেরে রুম-হিটারের উত্তাপ নিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম
পাখির কলতানে সকালে ঘুম ভাঙল লেকের মাঝখানে একটা ছোট্ট সুন্দর ঘর সরু সাঁকো দিয়ে তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হয়েছে লেকের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে সাঁকো পেরিয়ে চলে গেলাম সেখানে জলে পূর্ণ লেকটিকে উপভোগ করার হল আদর্শ স্থান

প্রাতরাশের পর সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছলাম প্রাচীন বৌদ্ধ গুম্ফায় উপর থেকে ছোচেনফেরি গ্রামের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য যেন ক্যালেন্ডারের ছবি গুম্ফার ভিতরে ফ্রেস্কো পেন্টিংয়ে ফুটে উঠেছে জাতকের নানান কাহিনি
ছোচেনফেরিতে রাত্রিবাস করে রোংলি হয়ে চলে যাওয়া যায় সিল্ক রুটের পথে সে পথে না গিয়ে বেলা ১১টা নাগাদ ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম লোসিং মাছোং-এর উদ্দেশে কিলোমিটার দূরেই রোলেপ খোলা স্থানীয়েরা ছিপ ফেলে মাছ ধরায় ব্যস্ত ঝুলন্ত সেতুতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করলাম পাহাড়বনানী আর নদীর অপূর্ব কোলাজ
আরও কিলোমিটার চলার পর গাড়ি থামল জঙ্গলাকীর্ণ পথের ধারে এখানেই লুকনো আছে রোলেপ বুদ্ধা ফল্ মূল রাস্তা থেকে দেখা যায় না সরুবিপদসঙ্কুলরোমাঞ্চকর পথ বেয়ে ২০০ মিটার নীচে পৌঁছলাম ঝর্নার কাছে উঁচু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুধসাদা প্রপাতটি
দুপুর দেড়টা নাগাদ পৌঁছলাম লোসিং মাছোং ছোচেনফেরি থেকে দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার এখানে রিভার ভ্যালি রিসর্টে আজ রাতের আস্তানা পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রোলেপ খোলা আর আছে সবুজে ঘেরা অমলিন প্রকৃতি বিকেলটুকু নদীর বয়ে চলার কুলকুল শব্দ উপভোগ করেই সময় কেটে যায়
বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গেছে শেষ বেলায় তাই শেষ রসটুকু আস্বাদনের আশায় অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলাম নদীর ধারে পর দিনই বাগডোগরা পৌঁছে কলকাতার বিমানে ফিরে যাব নাগরিক জীবনে সঙ্গে নিয়ে যাব অচিন গ্রামের রোম্যান্টিক স্মৃতিযা সযত্নে রেখে দেব মনের সিন্দুকে
যাত্রাপথ: হাওড়াশিয়ালদহ কলকাতা স্টেশন থেকে রেলপথে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন অথবা আকাশপথে বাগডোগরা গিয়ে ভাড়াগাড়িতে পৌঁছে যান পাকইয়ং-ইয়াকতেন অন্যান্য জায়গায় যাওয়ার জন্য ভাড়াগাড়িই সুবিধাজনক দিনপ্রতি সুমোবলেরোর ভাড়া ৩৫০০ টাকা ইনোভাস্করপিও জাতীয় গাড়ির ভাড়া ৪০০০ টাকা ছোট গাড়ির ভাড়া ৩০০০ টাকা গাড়ির জন্য যোগাযোগ করতে পারেন: ৮৪৩৬৬৪৯০০১৮৩৪৮৮১৩৮৪৫
থাকাইয়াকতেনপাস্তাঙ্গাছোচেনফেরিলোসিং মাছোং- রাত্রিবাসের জন্য যোগাযোগ: ৮৪৩৬৬৪৯০০১৮৩৪৮৮১৩৮৪৫৯৫০১৫৯১৩৮১
-মেল: yaaktenvillagehomestay@gmail.com
kiran@thewonderasiaholidays.com
আসামলিংজে ইয়াকচেরি হোম স্টে-তে রাত্রিবাসের জন্য যোগাযোগ: ৭৫৫৭৮২৩৩৩৯৯৫৯৩৮৮৯৭৭৭৯০৮৩৫৩৭০৬৭৮৬১৭৪৯৫১৪৬
প্রতিটি জায়গায় দৈনিক থাকাখাওয়া বাবদ খরচ জনপ্রতি ৮০০ টাকা
তবে সিজনভেদে গাড়িভাড়া হোমস্টে- খরচ ওঠানামা করতে পারে


 
Top