বিষয়টি জানার পর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায় মেয়েটির। যাকে
নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন ভার্সিটি পড়ুয়া মিতা দাস (ছদ্মনাম) সেই প্রেমিক একজন প্রতারক। হ্যালো
পার্টির সদস্য। এমনটি
কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। ‘হ্যালো’
পার্টির সদস্য দিদার মুন্সী তাকে
ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর দিকে। শুরুটাই ছিল প্রতারণা দিয়ে।
ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর দিকে। শুরুটাই ছিল প্রতারণা দিয়ে।
তারপর
কৌশলে গড়ে তুলেছে বন্ধুত্ব। একপর্যায়ে
প্রেম। অন্তরঙ্গ
সম্পর্ক। এরমধ্যেই
দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও চিত্র ধারণ করেছে দিদার। মিথ্যার
খোলস চোখে পড়তেই নিজেকে গুটিয়ে নেন মিতা। কিন্তু
বেপরোয়া দিদার মুন্সী। যে
কোনোভাবেই সম্পর্ক ধরে রাখতে চায়। অন্তঃরঙ্গ
মুহূর্তের ছবি, ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি-ধমকি দিয়ে বারবার কাছে ডাকে তাকে। উদ্দেশ্য
পূরণ না হলে তা ছড়িয়ে দিতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অবশেষে
ওই তরুণীর পাশে দাঁড়ায় সিটিটিসি’র সাইবার ক্রাইম ইউনিট। গ্রেপ্তার
করা হয় দিদার মুন্সীকে।
তদন্ত
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দিদার মুন্সীর বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণার মামলা রয়েছে। মোবাইলফোনে
নানা কৌশলে প্রতারণা করাই তার কাজ। দিদারের
রয়েছে একটি চক্র। প্রতারণার
মাধ্যমে মানুষের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রের সদস্যরা। বিশেষ
করে বিকাশের কাস্টমার কেয়ারের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করে তারা।
প্রতারণার
সূত্রপাত ২০১৭ সালের অক্টোবরের এক রাতে। মিতার
ফোনে কল আসে। নম্বরটি
প্রায় হুবহু একটি কোম্পানির কাস্টমার কেয়ারের নম্বর। পাঁচটি
সংখ্যার আগে ছিল একটি প্লাস চিহৃ।
কল
রিসিভ করতেই স্মার্ট একটি কণ্ঠ। ‘হ্যালো
ম্যাডাম, আমি কাস্টমার কেয়ার থেকে বলছি..।’ মিতাকে
জানানো হয়, গত মাসে তাকে একটি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে নাম, জাতীয় পরচিয়পত্র নম্বর ইত্যাদি চাওয়া হয়েছিল। তিনি
তা দেননি। যে
কারণে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই অ্যাকাউন্টটি ব্লক হয়ে যাবে।
কথা
শুনে মিতার অস্থিরতা বেড়ে যায়। বিকাশ
অ্যাকাউন্টে ১৮ হাজার ৬০ টাকা রয়েছে। তিনি
উপায় জানতে চাইলে ওই প্রান্ত থেকে কিছু তথ্য চাওয়া হয় তার। তারপর
বলা হয়, আপনি অন্য একটি নম্বর দেন, আমি ওই নম্বরে কল দিচ্ছি। কারণ
কথা বলতে বলতে অ্যাকাউন্টের এই ফোনের মাধ্যমে তাকে কিছু কাজ করতে হবে। যথারীতি
বড় বোনের ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। দিদারের
কথানুসারে বাটন চাপতে থাকেন। ব্যস। অ্যাকাউন্ট
হ্যাক। বুঝতে
পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এরমধ্যেই
প্রকৃত কাস্টমার কেয়ার থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হন।
বিষয়টি এখানেই শেষ হতে পারতো। প্রতারণার শিকার মিতা জানিয়েছেন, দিদার অন্যরকম একটা খেলা শুরু করে। কিছুক্ষণ পর কল দিয়ে বলে, ‘টাকা নিয়েছি বলে কি খারাপ লাগছে? সরি, জাস্ট মজা করে হ্যাক করেছি। টাকা নেয়ার জন্য না। ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে আপনার ফোন নম্বরটি সংগ্রহ করেছি। আপনার অ্যাকাউন্টটি ঠিক করে দিচ্ছি।’ পরদিন সকালে টাকাসহ অ্যাকাউন্টটি সক্রিয় করে দেয় দিদার। তারপর থেকে কারণে-অকারণেই কল দিতো। কথা হতো তাদের।
নিজেকে
ধনাঢ্য হিসেবে পরিচয় দিতো। দিদার
তাকে জানিয়েছে, ধানমণ্ডি, মিরপুর ও কুড়িলে মোট তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। উত্তরায়
আছে গাড়ির শো’রুম। পৃথিবীতে
মা ছাড়া তার আপন কেউ নেই। মা
থাকেন মামার বাড়িতে। ঢাকায়
কুড়িলে নিজের ফ্ল্যাটে এক মামাকে থাকতে দিয়েছে দিদার। মামা
গোলাম মাওলার পরিবারের সঙ্গেই থাকে সে। কথায়
কথায় নানাভাবে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করে মিতাকে। আকৃষ্ট
হোন মিতা।
এক মাসে পরেই দেখা হয় দিদার ও মিতার। গড়ে উঠে প্রেমের সম্পর্ক। মিতা জানান, বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতো দিদার। কখনো কখনো দামি মোটরসাইকেলে চড়ে দেখা করতে যেতো তার সঙ্গে। লং ড্রাইভে চলে যেতো দু’জন। ভাটারার কুড়িল মধ্যপাড়ার ক, ১৩৮/৩ বাসায় নিয়ে যেতো মিতাকে। সেখানে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের আগে বিয়ে করে সংসার করবে জানিয়ে আংটিও পড়িয়ে দেয় তাকে। দিদারের কথিত মামা গোলাম মাওলা সহযোগিতা করতো তাদের। ওই ফ্ল্যাটে প্রায়ই মিতার সঙ্গে একান্তে মিলিত হতো দিদার।
এমনকি
ঢাকার বিভিন্নস্থানেও নিয়ে গেছে মিতাকে। গত
মার্চ মাসে মাওয়া ঘাট সংলগ্ন একটি রিসোর্টে নিয়ে যায় তাকে। সেখানেও
অন্তরঙ্গ সময় কাটায় তারা। ছবি
তোলে। তখনও
মিতা বুঝতে পারেননি তার সরল বিশ্বাসের আড়ালে ঘটছে ভয়ঙ্কর ঘটনা। প্রতিটি
ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের দৃশ্য গোপনে ভিডিও ধারণ করছে দিদার। গত
১৭ই এপ্রিল ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার থানমাত্তা গ্রামে নিজের বাড়িতে যায় দিদার মুন্সী। ওই
দিন তার ফোনে কল দিয়ে থমকে যান মিতা। ওই
প্রান্ত থেকে এক নারী জানান তিনি দিদারের স্ত্রী।
দিদার
বিবাহিত। তার
তিন সন্তান রয়েছে। মিতার
মাথায় আকাশ ভাঙ্গে। ভাঙ্গা
মন নিয়েই সিদ্ধান্ত নেন যা হওয়ার হয়েছে, দিদারকে ভুলে বাঁচতে হবে তাকে। তার
থেকে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু
দিদার পিছু ছাড়ে না। মিতার
সঙ্গে এই সম্পর্ক রাখতে চায়। দু’জনের মধ্যে ফোনে বাকবিতণ্ডা হতেই থাকে। অতঃপর
শুরু হয় হুমকি-ধমকি। মিতাকে
জানায়, তার ছবিতো আছেই। এ
ছাড়াও গোপনে অন্তরঙ্গ সময়ের ভিডিও ধারণ করে রেখেছে। তা
ফেসবুকে, ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়া হবে। সবাই
জেনে যাবে। কোথাও
মুখ দেখাতে পারবেন না মিতা।
সত্যি
সত্যি তাই করে দিদার। ভিডিও’র কিছু অংশ পাঠিয়ে দেয় মিতার বড় বোনের ফেসবুকের ইনবক্সে। এরমধ্যেই
৩০শে এপ্রিল হাজারীবাগ থানায় একটি জিডি করেন মিতা। কিন্তু
দিদার বেপরোয়া। সমঝোতার
প্রস্তাব দেয়। স্বজনদের
পরামর্শে গ্রিনরোডের একটি রেস্টুরেন্টে দিদারের সঙ্গে দেখা করেন মিতা। ঘটে
আরো ভয়ঙ্কর ঘটনা। বাকবিতণ্ডার
একপর্যায়ে মিতার ফোনটি কেড়ে নিয়ে যায়। ওই
ফোনের দুটি নম্বর থেকে ইমোতে অ্যাকাউন্ট খুলে। এই
ইমো ব্যবহার করে মিতার স্বজন-বন্ধু সবাইকে বিশেষ মুহূর্তের ছবি, ভিডিও পাঠায় দিদার। ২৫শে
এপ্রিল থেকে ২৩শে মে’র মধ্যে ইমু ও ফেসবুকে মেসেঞ্জারে ভিডিও ও ছবি পাঠিয়ে হুমকি দিচ্ছিল দিদার।
মিতা বলেন, একের পর এক সবাই জেনে যাচ্ছে। বাসা থেকে বের হতে পারছি না। কারও সামনে যেতে পারছি না। আমার মনে হলো বেঁচে থাকা অর্থহীন। মান সম্মানতো গেল।
মিতা বলেন, একের পর এক সবাই জেনে যাচ্ছে। বাসা থেকে বের হতে পারছি না। কারও সামনে যেতে পারছি না। আমার মনে হলো বেঁচে থাকা অর্থহীন। মান সম্মানতো গেল।
আত্মহননের
দিকে এগুচ্ছিলেন চার্টার্ড সার্টিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন (এসিসিএ) অধ্যয়নরত এই তরুণী। তখনই
মিতার বোন-বান্ধবীরা তার পাশে দাঁড়ান। খবর
পেয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন তার বাবা। থানা
পুলিশের পরামর্শে সহযোগিতা নেন সাইবার ক্রাইম ইউনিটের। অতঃপর
২৫শে মে রাতে ওই ইউনিটের পরিদর্শক রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে কুড়িল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় দিদার মুন্সীকে। উদ্ধার
করা হয় কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ ও ছবি। এ
বিষয়ে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-কমিশনার মো. আলীমুজ্জামান বলেন, প্রতারক চক্রের সদস্য দিদার মুন্সী। তাকে
গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই
চক্রের অন্যান্য সদস্যদেরও গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা চলছে বলে জানান তিনি।