পূর্বপরিচিত একই এলাকার হওয়ায় ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) মোজাম্মেল হক বাহারের হাতে সন্তান জাহিদুল ইসলাম শাওনকে (১২) তুলে দিয়েছিলাম তারা বলেছিল পড়াশুনার পাশাপাশি টুকটাক কাজ করে নেবে তাই নির্ভয়ে শিশু শাওনকে নিজেই দিয়ে এসেছিলাম রাজধানীর ইস্কাটনের বাসায় কিন্তু পড়াশুনা তো দূরের কথা আমার ছেলেকে ওরা চুরির অভিযোগে নির্যাতন করেছে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও দেয়নি ছেলেকে ফিরে চাওয়ায় ডেকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে আমাকেও বেধড়ক পেটায়
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের গৃদকালিনদিয়া সাহেগঞ্জের বাসা থেকে ছেলে নির্যাতন চুরির অভিযোগে আটক করার খবর পেয়েই ছুটে আসেন শাওনের বাবা জাহিদুল হোসেন কালু (৪২) রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ রমনা থানার সামনে জাগো নিউজকে তিনি কথা বলেন
বৃহস্পতিবার (২১ জুন) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বাবা জাহিদুল ইসলাম কালু সদরঘাটে নামেন সিএনজি নিয়ে প্রথমে যান রমনা থানার পুরান ভবনে সেখান থেকে ফের রিকশা যোগে রমনা থানায় আসেন সঙ্গে ছিল খালাতো ভাই আবুল কাশেম ভাতিজা রায়হান
জাহিদুল হোসেন কালু বলেন, ‘ওরা আমার ঢাকায় আসার খবর শুনেছে বিভিন্ন জনকে দিয়ে আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নেয়া পুলিশি ঝামেলায় না জড়াতে হুমকি দিচ্ছে
আমি গরীব আমার সামর্থ্য ছিল না বলেই ছেলেকে ওদের হাতে গত নভেম্বরে তুলে দিছিলাম কিছু কাজ কর্মের মধ্যে যদি ওর পড়াশুনাটা হয় কিন্তু ভাগ্য খারাপ ওরা আমার ছেলেকে স্কুলে তো ভর্তি করায়নি উল্টা নির্যাতন করেছে আমি খোঁজ খবর নিতে চাইলেও খবর দেয়নি চুরির অভিযোগ তুলছে প্রতিবাদ করায় আমাকে গত জুন নারায়ণগঞ্জের খানপুর নিউ ব্যাংক কলোনির বাসায় ডেকে নিয়ে বেধরক পেটায়
ফোনে ধরায় দিয়ে বলে তুমি স্বীকার করো তোমার ছেলে চুরি করা টাকা বিকাশে তোমার কাছে পাঠাইছে নইলে খুন করে ফেলবো আমি তো এর কিছুই জানি না ছেলেকে জিগালে বলে আব্বা আমি চুরি করিনি এরপর এপাশে আমাকে ওপাশে ছেলেকে নির্যাতন করতে থাকে
কালু বলেন, গৃহকর্তা মোজাম্মেল হক বাহারের বউ তামান্না খান মিলি, ছেলে তানজিলুর রহমান এবং ভায়রা ইকবাল হোসেন সোহাগ তার স্ত্রী মিলে প্রচুর নির্যাতন করেছে ছেলেকে
জাহিদুল বলেন, থানার ওসি আমাকে অভয় দিয়েছে পুলিশ বাদী মামলা হয়েছে ওদের তিনজন আটক আছে আমি আমার ছেলে নির্দোষ আমাকে আমার ছেলেকে যারা নির্যাতন করেছে তাদের বিচার চাই মানুষ হয়ে মানুষকে এভাবে কেউ মারতে পারে না
ব্যাপারে রমনা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী মাইনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, শিশু গৃহকর্মী শাওন নির্যাতনের ঘটনায়নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে পুলিশ বাদী মামলা হয়েছে মামলা নং ৫৩ ওই মামলায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে আর শিশু শাওনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভর্তি করা হয়েছে
রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) এইচ এম আজিমুল হক জাগো নিউজকে বলেন, আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছে তাদের বিরুদ্ধে নারী শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে ওই ঘটনায় পলাতকদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে
উল্লেখ্য, শাওন গত সাত মাস ধরে রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের ১২/, নম্বর বাড়ির ১১ তলার ১১০২ নম্বর ফ্ল্যাটের গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছিল চুরির অভিযোগে গতকাল (২০ জুন) রাতে ব্যাপক নির্যাতন করা হয় শাওনকে
সন্ধ্যার পর বাথরুমে প্রবেশ করে ভেন্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে প্লাস্টিকের পাইপ বেয়ে ১১ তলা থেকে নিচে নেমে আসে সে এলাকাবাসীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে টের পেয়ে যান গৃহকর্তা এসে শাওনকে গার্ডরুম আটকে মারধর শুরু করেন বিষয়টি টের পেয়ে স্থানীয় একজন জরুরি সেবা৯৯৯ ফোন দেন দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন পুলিশ সময় আটক করা হয় তিনজনকে
পরে বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর রমনা থানায় কথা হয় শাওনের সঙ্গে জাগো নিউজের কাছে শাওন নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা দেয়
শাওন জাগো নিউজকে বলে, ‘ওই বাসায় পাঁচজন থাকত সবাই মারধর করতো একবার তাদের একটি স্যুটকেসের চাবি হারিয়ে যায় তাদের ধারণা আমি চাবিটি চুরি করে টাকা নিয়েছি এজন্য কখনও আমাকে রড দিয়ে কখনও বৈদ্যুতিক ক্যাবল দিয়ে পেটাত একবার ইলেক্ট্রিক সকও দেয় রড দিয়ে পিটিয়ে আমার পায়ের তালুও থেঁতলে দেয়া হয়
চাবি হারানোর পর একদিন বলে, ১০ হাজার টাকা পাচ্ছে না, আরেকদিন বলে ২০ হাজার টাকা পাচ্ছে না প্রতিদিনই আমাকে টাকার জন্য মারধর করতো আমি ভয়ে বলি যে, আমিই টাকা চুরি করেছি ওই ঘটনার কয়েকদিন পর ইকবাল নিজেই স্যুটকেসের চাবি খুঁজে পায় এরপর আর কিছু বলেনি
শাওন আরও বলে, ‘আমাকে ঢাকায় পড়াশোনা করানোর কথা বলে আনা হয় কিন্তু পড়াশোনা তো দূরের কথা দিন-রাত ঘরের কাজ করতে বাধ্য করা হয় প্রতিদিনের বাজার থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা আমাকে দিয়ে করানো হয়নি কাজের বিনিময়ে আমাকে কোনো টাকা দেয়া হতো না
একদিন দিলুরোড থেকে কাঁচাবাজার কিনে আনার পর আমাকে অনেক মারধর করা হয় তামান্না আমাকে বলতো, গত সপ্তাহে কম দামে তরকারি এনেছিস, এবার বেশি কেন? বল কত টাকা মারছস?’
মারধরের ওই ঘটনার পর আমি মাঝে মাঝে ফোনে বাবার সঙ্গে কিংবা গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতাম তখন আমি যাতে নির্যাতনের কথা না বলতে পারি সেজন্য সবসময় আমার সামনে বসে থাকতো তানজিলুর একদিন ফোনে কথা বলার আগে ছুরি এনে আমার গলায় ধরে রাখে আমি যদি ফোনে মারধরের বিষয় বাড়িতে জানাই তাহলে আমাকে হত্যা করবে বলে হুমকি দেয় আমি ভয়ে বাড়িতে কিছুই বলিনি রোজার শেষের দিকে তারা আমার বিরুদ্ধে আড়াই লাখ টাকা চুরির অভিযোগ আনে যদিও আমি চুরি করিনি ২০ জুনের মধ্যে টাকা ফিরিয়ে না দিলে আমাকে মারধর করবে আর বাবাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে বলে হুমকি দেয় ওই ভয়ে আমি বাথরুম থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নামি

 
Top