এম. সাফায়েত হোসেন:
‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই/ পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’ বহুল প্রচারিত এই কবিতাকে যথার্থ রূপ দিয়েছেন মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম ও গোবিন্ধল এলাকার স্বর্ণ কারিগররা। দেশে সোনার খনি না থাকলেও ছাই থেকে এসব কারিগর বের করে আনছেন কেজি কেজি স্বর্ণ। এ ব্যবসার সঙ্গে প্রায় ৫ হাজার কারিগর জড়িত। আর এই কারিগরদের ওপর জীবিকানির্বাহ করেন অন্তত ২৫ হাজার লোক। তাদের ব্যবসাই হচ্ছে- ছাই সংগ্রহ করা এবং বিশেষ কায়দায় তা পুড়িয়ে সোনা ও রুপা বের করা। কাজটি যদিও কঠিন; কিন্তু বংশানুক্রমে তা রপ্ত করে নিয়েছেন এসব নিপুণ কারিগর। তাই চারিগ্রাম ও গোবিন্দল গ্রামের নাম পাল্টে লোকে এখন ‘সোনার গ্রাম’ বলেও ডাকেন। সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, চারিগ্রাম, দাসেরহাটি ও গোবিন্ধল গ্রামে ছাই থেকে সোনা তৈরির কাজটি ব্রিটিশ আমল কিংবা তারও আগে থেকে চলে আসছে। সে সময়ে ঢাকা মহাকুমার মানিকগঞ্জে প্রথম এ ব্যবসাটি শুরু করেন চারিগ্রামের হাজি পীর বক্স তালুকদার ওরফে পীরু ব্যাপারী। তিনি সে সময়ে ঢাকার (বর্তমান টাঙ্গাইল) চৌহাট ইউনিয়ন থেকে এ প্রয্ুিক্ত শিখে বিভিন্ন জেলা থেকে সোনার দোকানের ছাই কিনে ব্যবসাটি শুরু করেন। তারপর থেকেই বংশানুক্রমে আজকে এর বিস্তার লাভ করছে। তার আদলেই আজ হাজারো লোক এ ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এসব তথ্য জানান, প্রয়াত হাজি পীর বক্স তালুকদারের নাতি বাংলাদেশ স্কাউটস-এর সহকারী লিডার ট্রেইনার আবদুল হক তালুকদার (৬৫)। ছাই থেকে সোনা তৈরিকে কেন্দ্র করে চারিগ্রাম বাজারে সোনার হাটও বসে। গল্প বা লোককথা নয়, এখানে প্রতিদিন স্বর্ণ বেচাকেনা হয় কেজির ওজনে। বিভিন্ন জায়গা থেকে এ হাটে এসে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সোনা কিনে নেন। তবে চোরাকারবারীরা এ চারিগ্রাম হাটটিকে নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে বেছে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এখানে রয়েছে ৪০/৫০টি সোনার দোকান। কারিগরদের কাছ থেকে এ সোনা কিনে বিক্রি করে থাকেন এসব দোকানের মালিকরা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন ‘ছাই’ ব্যবসায়ীরা। তাদের কাজ শুধু ছাই কেনা এবং তা থেকে সোনা বের করা। ছাই থেকে সোনা তৈরির গোপন বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয় এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মো. রফিকুল ইসলাম (৫৫) ও দুদু মিয়ার (৪৫) সঙ্গে। তারা জানান, সোনার দোকানের পরিত্যক্ত ছাই, মাটি কিংবা ধুলা কিনে থাকেন বরিশাল, ভোলা, দৌলতখান, হাতিয়া, চাঁনপুর, স›দ্বীপ, নোয়াখালী, মাইজদী, চৌমহনী, নাঙ্গলকোট, ফেনী, লাকসাম, হাজীগঞ্জ, কঁচুয়া, মতলব, ফরিদগঞ্জ, লক্ষীপুর, গৌরনদী, উজিরপুর ও ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে। বিশেষ করে ঢাকার তাঁতীবাজারের ছাই কিনে সেগুলো পোড়ানো হয় সোহাগা, ব্যাটারির সীসা, চুন, কয়লা, পাটখেল ও আরো কিছু উপকরণসহ রাসায়নিক দিয়ে। আগুনে পুড়িয়ে তা গলিয়ে সীসা বানিয়ে চাকা তৈরি করে ঢেঁকিতে পার দিয়ে গুঁড়ো করা হয়। ঢেঁকি ভানার কাজটি নারীরাই করে থাকেন। এরপর মাটিতে গর্ত করে চুন ও ধানের তুষ দিয়ে পুড়িয়ে সীসা বের করা হয়। তারপর ছাকনি দিয়ে ঝেঁকে পানিতে ধুয়ে সীসা আলাদা করা হয়। ওই সীসার চাকাকে নাইট্রিক এসিড দিয়ে পুড়িয়ে আলাদা করে সোনা বের করা হয়। তারা আরো বলেন, কোন ছাই কিনলে কতটুকু সোনা বের করা যাবে তা দেখলেই আমরা বুঝতে পারি। ২৫ লাখ টাকা চালানে ৭ লাখ টাকা খরচে ১০০ ভরি পর্যন্ত স্বর্ণ বের করা যায়। এই পরিমান স্বর্ণের দাম ৪০ লাখ টাকা হলেও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আয় হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। এ ব্যবসায় ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে কোটিপটি হয়েছেন- ওমর কোম্পানি, নাজিমুদ্দিন, আনছু ও গেদু ব্যাপারী, খলিল পোদ্দার, নয়া মিয়া ও আওলাদ হোসেনসহ অনেকে।
জাহাঙ্গীর জুয়েলারি স্টোরের মালিক ওহাব আলী পোদ্দার ও আরেক ব্যবসায়ী মহর আলী বলেন, দোকানের আকার ভেদে আমরা ছাই ও মাটি ৫০০ থেকে ৫ লাখ টাকায়ও কিনে থাকি। এ মাটি বা ছাই থেকে ১ ভরি থেকে ১০ ভরি পর্যন্ত সোনা বের করা যায়। আবার যাদের চালান নেই, তারা অন্যের চালানেও কিংবা বাকিতেও ব্যবসা করতে পারে। তবে মহাজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা করলে চড়া সুদ দিতে হয়। মহাজনদের সুদের ঘানি টানতে গিয়ে অনেকে পথে বসার উপক্রম হয়েছেন। তারা আক্ষেপ করে বলেন, এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশই লেখাপড়া জানেন না। কষ্ট করে বিভিন্ন স্থান ঘুরে ছাই-মাটি কিনে বস্তায় ভরে আনার পথে রাস্তায় পুলিশ তল্লাশির নামে ঝামেলা করে। বিশেষ করে গাবতলী বাসটার্মিনালে পুলিশের হয়রানি বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়া সোনা বিক্রি করতে গেলেও পুলিশ তা ভয় দেখিয়ে কেড়ে নেয়। সম্প্রতি কয়েকটি স্বর্ণ ছিনতাইয়ের ঘটনায় আতঙ্কে আছেন বলেও একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন।
নাদিয়া জুয়েলার্সের মালিক হাজি পাচু পোদ্দার বলেন, ‘শুধু ছাই থেকেই সোনা বের হয় না। আমি নিজেও এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এক্সরে কালার ল্যাব, জনি টেক্সটাইল, পাকিজা টেক্সটাইল, হোমটেক্স ও আউটপুটের বাতিল ফিকচারের পানি ক্রয় করে তা থেকে রূপা বের করি আমি। এগুলো অপরিশোধিত রুপা। এ ছাড়া সিরামিক্স থেকে রুপা ও সোনা বের করা যায়। টেন্ডারের মাধ্যমে এগুলো ক্রয় করে প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে সোনা ও রুপা বের করা হয়। সিরামিক্সের লিক্যুইড ও ন্যাংকরা- যেগুলো অব্যবহৃত বাতিল বলে গণ্য করে ফেলে দেয়া হয়, যা কিনা পরিবেশকে দূষণ করে থাকে, সেগুলো আমরা কিনে থাকি এবং বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে সোনা বের করি। অর্থাৎ যেগুলো বর্জ্য হিসেবে ফেলে দিলে পরিবেশ দূষণ হয়, সেগুলোকে আমরা পুনরুদ্ধার করি হারানো সম্পদ থেকে’। হাজি পাচু পোদ্দার এ প্রতিবেককে সোনার গ্রামে নিয়ে যান এবং স্বর্ণ আহরণের পদ্ধতিগুলো ঘুরিয়ে দেখিয়ে ছবি তুলতে সহযোগিতা করেন।
গোবিন্ধল গ্রামের সোনার কারিগর শাহজাহান মিয়া জানান, রাসায়নিক, সোহাগা ও ব্যাটারির ছাইয়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো অতো লাভ হয় না। তবুও এ ব্যবসা করে আমরা ভালোই আছি। তবে একই গ্রামের ব্যবসায়ী হাবু পোদ্দার বলেন, সরকারিভাবে এ ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স দেয়া হলে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে এ ব্যবসা বিস্তার লাভ করতে পারে। পাশাপাশি সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারে। একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে; অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তবে বর্তমানে এ ব্যবসার দুর্দিন চলছে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকে জানিয়েছেন।
চারিগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান সাজেদুল আলম স্বাধীন বলেন, সোনার দোকানের পরিত্যক্ত ছাই থেকে খুবই পরিশ্রম করে কারিগররা সোনা বের করেন। এরা দেশের অর্থনীতিতে কোটি কোটি টাকার যোগান দিচ্ছেন। অথচ পুলিশ তাদেও হয়রানি করে। বিষয়টির দিকে সরকারের নজর দেয়া দরকার। তাতে দেশেরও মঙ্গল হবে, আর এরাও স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারবেন।
এ ব্যাপারে সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ জাহিদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ পোদ্দার সমিতি ও জুয়েলার্স সমিতির সঙ্গে আলাপ করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে চারিগ্রাম ও গোবিন্দলের স্বর্ণ কারিগররা যাতে বৈধভাবে ব্যবসা করতে পারেন, সেজন্য প্রয়োজনীয় ঋণসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।