এম. সাফায়েত হোসেন: সেম্পের পরিচালক রবি খান। রবি খানের ভেষজ চাষ এখন মধুপুর গড় থেকে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী গারো পাহাড়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে। ভেষজ বৃক্ষের জন্য মধুপুর গড় এক সময় বিখ্যাত ছিল। বন ধ্বংসের সাথে সাথে বাড়ছে ফসলের আবাদ। ফলে মধুপুর বনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ভেষজ, গুল্মলতাসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে। ফলে মধুপুর গড়াঞ্চলে বসবাসরত গারো, কোচ, বর্মনসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কবিরাজরা লোকায়িত চিকিৎসার জন্য এ বনের বিভিন্ন ভেষজবৃক্ষ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত। ভেষজবৃক্ষ মধুপুর বন থেকে হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের লোকায়িত চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এ পেশার সাথে জড়িত কবিরাজরা অনেকটাই হতাশ ও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা দেখে এক দশক আগে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র রবি খান এ বিষয়ে ভাবতে শুরু করেন। কিভাবে হারিয়ে যাওয়া ভেষজ বৃক্ষের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যায় তা নিয়ে ভাবনার এক পর্যায়ে মধুপুর বনে ঘুরে হাতেগোনা কয়েকটি ভেষজবৃক্ষ খুঁজে পেয়ে ব্যাপক খুশি হন। বেড়ে যায় তার আগ্রহ। এরপর ভেষজের সন্ধানে মধুপুর বন চষে বেড়ান। হঠাৎ একদিন বন এলাকার টেলকি নামক স্থানে স্থানীয় গারো নারী নির্মলা হাদিমার সাথে কথা হয়। এরপর নির্মলা হাদিমাকে সাথে নিয়ে শুরু করেন বিলুপ্তপ্রায় ভেষজের সংগ্রহ। এভাবে কয়েক মাসের ব্যবধানে নির্মলার বাড়িতে সংগ্রহ করা ভেষজের গাছগুলো রোপণ শুরু করে। বাড়তে থাকে চাষ। সংগ্রহ ও সংরক্ষণ যেন তাদের নেশায় পরিণত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে টেলকির বন এলাকার সবুজ পল্লী প্রকৃতির নির্মলা হাদিমার বাড়ির আঙ্গিনা ভেষজে ভরে উঠে। আশপাশের গায়রা, জলই, রাজাবাড়ি, মাগন্তিনগর, জলছত্র, পচিশমাইল, রসুলপুর, বেরিবাইদসহ বিভিন্ন গ্রামের লোকেরা তার ভেষজ বাগান দেখতে আসা শুরু করে। এ চাষে আশেপাশের এলাকার মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। রবি খান ও নির্মলা হাদিমা তাদেরকে উৎসাহিত করে বিনামূল্যে ২-১টি করে চারা বিতরণ শুরু করে। নির্মলা হাদিমা ভেষজ চাষ করে এখন সাবলম্বি হয়েছে। তার দেখাদেখি মধুপুর গড় এলাকায় এখন প্রায় ১০টি গ্রামে অর্ধশতাধিক চাষী বাণিজ্যিকভাবে ভেষজ চাষ শুরু করেছে। ভেষজের বাণিজ্যিকভাবে চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় মধুপুর গড় এলাকার বিভিন্ন গ্রামের চিত্র বদলে যাচ্ছে। প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপশি বাড়তি আয় রোজগার হওয়ায় অনেকেই দারিদ্র্য বিমোচনে ভেষজ চাষকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে। টেলকি গ্রামের নির্মলা হাদিমা এক সময় বাড়িতে চু (গারো মদ) তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কখনো গারো মদের চাহিদা কমে গেলে সংসারে অনটন দেখা দিত। গারোদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সংসারের খরচ তাকেই নির্বাহ করতে হয় বলে দুর্দশার অন্ত ছিলনা। এখন ভেষজ বৃক্ষের চাষ করে দশ বছরের ব্যবধানে তার মাসে আয় হয় ১০-২০ হাজার টাকা। বাড়ির আঙ্গিনায় সৃজন করা দেড় বিঘা জমির ভেষজ বাগানে রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে আগামী দিনের জন্য স্বপ্নের জাল বুনেন। সরেজমিনে মধুপুর গড়ে টেলকি গ্রামে নকমান্দি ও পেগামারি খামারে গিয়ে নির্মলা হাদিমার সাথে কথা বলেআদিবাসী ভাষা গবেষক ও সেম্প এর চেয়ারম্যান রবি খান নির্মলা হাদিমার বাগানে উৎপাদিত ভেষজ এ্যালোপ্যাথিক কোম্পানি, আয়ুর্বেদ, ইউনানী, হোমিও ও কবিরাজ ঘরে কাচাঁমাল হিসাবে বিক্রির বন্দোবস্ত করে দেন। বাসক, শতমূলি, সর্পগন্ধা, কালমেঘা, অশ্বগন্ধা, নাগদানা, পুদিনা, অর্জুন, থানকুনি, চিতামূল, আমলকি, বহেড়া, হরিতকি, ঘৃতকুমারী, নাগেশ্বর, সোনালু, মেথি, যষ্ঠিমধু ও বিহিদানাসহ প্রায় শতাধিক প্রজাতির দুর্লভ ও বিলুপ্ত প্রায় ভেষজের আবাদ হচ্ছে। বাজারজাত ও বিপননে শুধুমাত্র এপি কোম্পানি এখান থেকে ১৪৭ প্রকার ওষুধি বৃক্ষের কাচাঁমাল কিনে নেয়। সেম্পের সহযোগিতায় চাষীরা কয়েকটি ভেষজ নার্সারি গড়ে তুলেছে। এসব নার্সারিতে বিপুল পরিমাণ ভেষজ চারা রয়েছে। ২০০৮ সালে সেম্পের পরিচালক রবি খান ভাবলেন মধুপুরের মাটি আর ঝিনাইগাতির মাটি একই প্রকৃতির।সেম্প (সোসাইটি ফর প্রটেকশন অফ মেডিসিনাল প্ল্যান্ট এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট) এর চেয়ারম্যান রবি খান জানান, এ পর্যন্ত সেম্প ১৫টি এনজিওকে ভেষজ চাষের উপর বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। রবির আলো এখন মধুপুর গড় থেকে ঝিনাইগাতী গারো পাহাড়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে।