ঢাকার
ইস্কাটনে নির্যাতনের শিকার হয়ে এক শিশু বাফরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে নিচে নেমেছে।
পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় পুলিশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় রমনা থানা পুলিশ তিনজনকে আটক করেছে।
আটককৃতরা
হলেন, গৃহকর্তা মোজাম্মেল হোসেন বাহারের স্ত্রী তামান্না খান মিলি ও ছেলে তানজিলুর
রহমান ও গৃহকর্তা ভায়রা ইকবাল হোসেন সোহাগ। ঘটনার পর থেকে গৃহকর্তা মোজাম্মেল হোসেন
বাহার পলাতক রয়েছেন।
জানা
যায়, ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনের ১২/এ, নম্বর বাড়ির ১১তলার ১১০২ নম্বর ফ্ল্যাটে টুকটাক
ঘরের কাজ করার পাশাপাশি পড়ালেখা করার শর্তে গত ৭ মাস পূর্বে কাজে যায় শাওন।
কিন্তু
সেই আশায় নিরাশায় পরিণত হয় জাহাঙ্গীর আলম কালুর। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তার
ছেলে জাহিদুল ইসলাম শাওন বাধ্য হয়ে বাথরুমের ভ্যান্টিলেটর দিয়ে বেরিয়ে ১১তলা থেকে বাথরুমের
পাইপ দিয়ে নিচে নেমে এসে প্রাণে বাঁচে।
বিষয়টি
স্থানীয় এক বাসিন্দার নজরে এলে তিনি ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন দিয়ে সহায়তা চান। তাৎক্ষণিক এগিয়ে
আসেন রমনা থানা পুলিশ। তারা অভিযান চালিয়ে ওই বাসার গার্ডরুম থেকে শাওনকে বন্দি অবস্থায়
উদ্ধার করেন। রমনা থানা পুলিশ তিনজনকে আটক করে।
পরে
গৃহকর্মী নির্যাতনের সত্যতা পাওয়ায় মামলা করে পুলিশ।
সরেজমিন
শুক্রবার দুপুরে উত্তর সাহেবগঞ্জ গ্রামের দিঘীর পাড়ে শাওনদের বাড়ি গেলে কথা হয় জাহিদুল
ইসলাম শাওনের মা হাফজা বেগমের সাথে। তিনি জানান, এক ছেলে দুই মেয়ের জননী তিনি। বাপের
বাড়ি গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নের সরকার বাড়ি। স্বামী জাহাঙ্গীর আলম কালু এক গত সাত মাস
আগে তাকে স্থানীয় রুবেল খাঁর সহযোগিতা নিয়ে ওই বাসায় দেয়া হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত
একটি বারের জন্য ছেলের মুখ দেখিনি। বেশ কয়েকবার তাকে বাড়ি আসার জন্য বললেও ওই পরিবারের
লোকজন ছেলে বাড়ি গেলে নষ্ট হয়ে যাবে। পড়ালেখার ক্ষতি হবে।
আমাদের
কাছে সে আদরেই রয়েছে, এই ধরনের কথা বলতেন। আমরাও সরল বিশ্বাসে ছিলাম। রমজান মাসে আমরা
সিদ্ধান্ত নেই ১৫ রমজানের সময় ঢাকায় শাওনকে দেখতে যাবে তার বাবা এবং ঈদে যেন তাকে বাড়িতে
আসতে দেয়, সেই জন্য বলে আসবে। ফোনে ঢাকা যাবেন বলে জানায় তার স্বামী। কিন্তু ১৭ রজমানে
হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়।
ঢাকা
থেকে তার মোবাইল ফোনে কল আসে। শাওন মোজাম্মেল হোসেন বাহারের বাসা থেকে দেড় লাখ টাকা
চুরি করে তার মায়ের বিকাশ অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছে।
এ
সময় তারা বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে বলেন, আমরা আমাদের ফোন তল্লাশি করে প্রমাণ নিন। পরদিন
তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম টিকুর সঙ্গে কথা বলে নারায়ণগঞ্জ গেলে সেখানে তাকে আটকে রেখে
নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে নির্যাতনের মুখে তার স্বামীর মুখ থেকে দেড় লাখ টাকা চুরির
কথা বের চেষ্টা করেন।
তিনি
দ্রুত রুবেল খাঁর কাছে গিয়ে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য খায়ের পাটওয়ারীর
ভাই বাসু পাটওয়ারীর সহযোগিতা নেন। তিনি মোবাইল ফোনে ঢাকার মোজাম্মেল হোসেন বাহারের
পরিবার ও নারায়ণগঞ্জের টিকুর সঙ্গে কথা বলে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন।
একপর্যায়ে
তার সহযোগিতা নিয়ে স্বামী জাহাঙ্গীর আলমকে তার হাত থেকে মুক্ত করতে পারলেও ছেলেকে পারেননি।
পরে গত ২০ জুন নির্যাতনের মুখে শাওন ১১তলার পাইপ বেয়ে নেমে এসে স্থানীয় লোকজনের কাছে
আশ্রয় পায়। তারা ৯৯৯ নম্বরে পুলিশের কাছে ফোন দিলে পুলিশ উদ্ধার করে নিয়ে যায় শাওনকে।
বর্তমানে সে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
হাসপাতালে
শাওনের পাশে থাকা জাহাঙ্গীর আলম কালু শুক্রবার বিকালে মোবাইল ফোনে জানান, নির্যাতনের
ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়েরের পর তিন আটক হয়েছে। তাদের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।
তিনি জানান, এখনো মোজাম্মেল হোসেন বাহারের লোকজন তাকে ফোনে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।
হাসপাতালে
চিকিৎসাধীন শাওন যুগান্তরকে জানায়, ‘ঢাকার ওই বাসায় পাঁচজন থাকত। সবাই আমাকে মারধর
করত। একবার তাদের একটি স্যুটকেসের চাবি হারিয়ে যায়। তাদের ধারণা আমি চাবিটি চুরি করে
টাকা নিয়েছি। এজন্য কখনও আমাকে রড দিয়ে কখনও বৈদ্যুতিক ক্যাবল দিয়ে পেটাত। একবার ইলেকট্রিক
শকও দেয়। রড দিয়ে পিটিয়ে আমার পায়ের তালুও থেঁতলে দেয়া হয়।’
স্যুটকেসের
চাবি হারানের ঘটনায় তাকে হুমকি দেয় তারা। বলে ‘২০ তারিখের মধ্যে টাকা ফিরিয়ে না দিলে
তোকে আগের মতো ইলেকট্রিক শক দেব। গ্রামে লোক পাঠিয়ে তোর বাবাকে ধরে আনব’।
গৃহকর্তা
মোজাম্মেল হোসেন বাহারের শ্যালক মো. ইকবালের এমন হুমকি-ধামকিতে মৃত্যু ভয় প্রবেশ করে
১২ বছরের শিশু জাহিদুল ইসলাম শাওনের ভেতর। এ কারণে গত ২০ জুন আশ্রিত বাড়ি থেকে পালানোর
সিদ্ধান্ত নেয় সে। তবে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাড়িওয়ালা আর দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে
বের হওয়া মুশকিল।
তাই
সন্ধ্যার পর বাথরুমে প্রবেশ করে ভেন্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে প্লাস্টিকের পাইপ বেয়ে ১১তলা
থেকে নিচে নেমে আসে সে। এলাকাবাসীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে টের পেয়ে যান গৃহকর্তা মোজাম্মেল
হোসেন বাহার। এসে শাওনকে গার্ডরুম আটকে মারধর শুরু করেন। বিষয়টি টের পেয়ে স্থানীয় একজন
তাকে উদ্ধার করে।
শাওন
জানায়, গত ৭ মাসে তাকে নানা কারণে নির্যাতন করা হতো। পুরো শরীরে রয়েছে নির্যাতনের দাগ।এক
দিনের জন্যও তাকে পড়ালেখার জন্য বলেনি। অথচ এই জন্য মাদ্রাসা থেকে সব কাগজপত্র এনে
দিয়েছিল তার বাবা।
সে
জানায়, ‘আমাকে ঢাকায় পড়াশোনা করানোর কথা বলে আনা হয়। কিন্তু পড়াশোনা তো দূরের কথা দিনরাত
ঘরের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। প্রতিদিনের বাজার থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা আমাকে
দিয়ে করানো হয়নি। কাজের বিনিময়ে আমাকে কোনো টাকা দেয়া হতো না।
ঢাকার
রমনা মডেল থানার ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান , শিশু গৃহকর্মী শাওন নির্যাতনের
ঘটনায় ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পুলিশ বাদী মামলা হয়েছে ।
রমনা
মডেল থানার এসআই মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। আটক তিনজনকে মামলায় গ্রেফতার
দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। আর শিশু
শাওনের সুস্থতার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে
উপস্থিত হওয়া রমনা থানার এসআই মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান , ‘আমি তাকে উদ্ধার
করতে গেলে তারা আমাকে ভুল তথ্য দেয়। নির্যাতনের শিকার শিশুকে চোর বলে আটকে রাখে। পরে
বাড়িতে থাকা তিনজনকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা মারধরের কথা স্বীকার করে। শিশুটির
হাতে-পায়ে, পায়ের তালুতে ও পিঠে নির্যাতনের দাগ রয়েছে। তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল
কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’
পুলিশের
রমনা জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এইচ এম আজিমুল হক সাংবাদিকদের জানান, ‘আসামিরা
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করেছে। মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই
ঘটনায় আরও যারা যারা পলাতক আছেন তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
সূত্র:
দৈনিক যুগান্তর