বাংলাদেশে খাওয়ার জন্য উপযুক্ত পর্যায়ের মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প নেই বললেই চলে। তবে আশার কথা কিছু প্রতিষ্ঠান অল্প পরিমাণ খাওয়ার উপযুক্ত পর্যায়ের প্রক্রিয়াজাত মাছ তৈরি করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে তিনটি ফিশ ফিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হয়েছে। যা অবশ্য খাওয়ার জন্য উপযুক্ত পর্যায়ের খাদ্য উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ প্রসেসিং উপযোগী মাছ চাষ হচ্ছে। এগুলো প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারে বাজারজাত করার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি বিদেশেও রফতানির সম্ভাবনা আছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, প্রায় এক কোটির ওপরে বাংলাদেশি বিদেশে বসবাস করছেন। একই ধরনের চাহিদার কারণে বিদেশে বসবাসরত ভারত উপমহাদেশীয় জনগোষ্ঠীর বাজারেও বাংলাদেশি খাদ্যের বাজারজাত সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বেশকিছু খাওয়ার উপযুক্ত হিসেবে হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ রফতানি হচ্ছে। এমনকি বর্তমান পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে খাওয়ার উপযুক্ত পর্যায়ের মাছ প্রক্রিয়া করে বাজারজাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মাছ ক্যানিং শিল্প গড়ে ওঠেনি। টুনাসহ বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ক্যানিংয়ের মাধ্যমে বাজারজাত করার বিশাল সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে একই অধিদফতরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ব্যাপক পরিমাণ মাছের কাটা ও আঁশ সংবলিত বর্জ্যরে উৎপাদন। সেই বর্জ্যরে বাণিজ্যিক ব্যবহার সম্ভব না হলে মাছ প্রত্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী হিমায়িত খাদ্যের রফতানির আয়ের ৮০ শতাংশ হয় চিংড়ি মাছের মাধ্যমে। আর বাকি ২০ শতাংশ অন্যান্য মাছ ও পণ্য থেকে। মাছ ও রান্নার জন্য তৈরি পর্যায়ে প্রক্রিয়াজাত মাছের বাণিজ্যের পরিমাণ ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বেশ ভালোই ছিল। অর্থাৎ প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ বেড়েছে। যেমন ২০১১ সালে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০১৫ সালে এসে তা কিছুটা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৮৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। একইভাবে বাংলাদেশে রান্নার জন্য তৈরি মাছের ৫ বছরে বাণিজ্যের মধ্যে বেশ কিছুটা ওঠানামা করে। ২০১১ সালে যেখানে রফতানি আয় ছিল ৬৫০.৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে ২০১৫ সালে এসে দাঁড়ায় ৪৯৮.৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বে খাওয়ার জন্য তৈরি পর্যায়ে প্রক্রিয়াজাত মাছের প্রধান আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, হংকং, কানাডা, স্পেন। আর রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- চীন, নরওয়ে, ভারত, ভিয়েতনাম, চিলি, সুইডেন, রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করে, বাংলাদেশের খাওয়ার জন্য তৈরি ও রান্নার জন্য তৈরি পর্যায়ের মৎস্য শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের তো অপার সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে ফিশ ক্যানিং শিল্প গড়ে উঠতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে প্রক্রিয়াকরণের ব্যয় বেশি হওয়ার ফলে সরাসরি মাছ প্রক্রিয়াকরণে না গিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে কাঁচামাল হিসেবে মাছ প্রসেস করে থাকে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি প্রতিবেদনে বাংলাদেশে এই শিল্পের ৯টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- মৎস্য নির্ভর চূড়ান্ত খাদ্য প্রসেসিং অভাব, খাদ্য উৎপাদন প্রযুক্তির অভাব, দক্ষ জনবলের অভাব, পুঁজি বিনিয়োগে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনীহা, পুঁজির উচ্চহার সুদের হার, বাজার চাহিদা সম্পর্কে সচেতনার অভাব ও বাজারজাত করার ব্যাপারে কার্যক্রমের অভাব। প্রতিবেদনে প্রায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে ১২টি সুপারিশ করা হয়েছে। স্বল্প মেয়াদে সুপারিশের ৩টির মধ্যে রয়েছে- খাদ্য প্রসেসিং শিল্প স্থাপেেন উৎসাহিত করতে ট্যাক্স হলিডেসহ বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা দেয়া, নগদ সহায়তা দেয়া, সব প্রজাতির মাছের আমদানি ও প্রক্রিয়াকরণের পর শতভাগ রফতানির ব্যবস্থা করা। মধ্যমেয়াদে ৬টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, মৎস্যজাত খাদ্যের মান নিশ্চিত করা। আর দীর্ঘমেয়াদে ৩টির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মৎস্য বর্জ্যরে প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনে সম্ভাব্য উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা।
 
Top