যুগের
হাওয়ায় নগরজীবনে ঢুকে গেছে ‘ডিজে পার্টি’ নামের এক উদ্ভট সংস্কৃতি। এটি
হয়ে ওঠেছে নব্য এলিট শ্রেণির মনোরঞ্জন ও দেহ-বিনোদনের অংশ। ডিজে
কালচার এখন কেবল বড় বড় অভিজাত হোটলেই সীমিত নেই। রাজধানীর
গুলশান-বনানী-উত্তরাসহ নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে ডিজে ক্লাব। রাজধানীর
আশেপাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রিসোর্টে আয়োজিত হচ্ছে নিয়মিত ডিজে পাটি। এইসব
ডিজে পার্টির আকর্ষণ হলো চিয়ার্স গার্লরা। লাবনী
আক্তার কনিকা নামের এমনই এক ডিজে চিয়ার্স গার্ল সম্প্রতি সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন।
ডিজে
পার্টির ড্যান্সার কনিকা প্রেমে পড়েছিলেন সৈকত নামের এক বিবাহিত তরুণের। তার
এই পরকীয়া প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন প্রেমিকের বাবা শাহ আলম ভূঁইয়া। তারই
জেরে ক্ষুব্ধ হয়ে খুনের পরিকল্পনা করেন প্রেমিকা লাবনী আক্তার কনিকা। পরিকল্পনা
অনুযায়ী কৌশলে বাসায় ডেকে নেন জনশক্তি ব্যবসায়ী ৭৫ বছর বয়সী শাহ আলমকে। শ্বাসরোধে
হত্যার পর তার লাশ স্যুটকেসে ভরে গুমের উদ্দেশে অটোরিকশায় করে ঢাকার সড়কে ঘুরেছে কয়েক ঘণ্টা। টাকা
ভাঙতি নেয়ার কথা বলে অটোরিকশায় লাশ রেখে সটকে পড়েন ‘খুনি’ কনিকা। গত
৮ এপ্রিল খিলগাঁও তিলপাপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে।
ডিজে
পার্টির পেশাদার চিয়ার্স গার্ল কনিকার এই নৃশংসতা দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি করে। নতুন
করে সামনে নিয়ে আসে ডিজে পার্টি আর চিয়ার্স গার্লদের। এর
আগে শান্তিনগরের কিশোরী ঐশির বাবা-মা হত্যার ঘটনার পর ডিজে কালচার নিয়ে তৈরি হয়েছিল তুমুল বিতর্ক। এবার
প্রশ্ন ওঠেছে, কারা এই চিয়ার্স গার্ল? স্বল্প পোশাকে চেনা-অচেনা পুরুষের বাহুলগ্ন হয়ে নাচানাচি করাটা কি তাদের নেশা নাকি পেশা? ডিজে পার্টিতে পুরুষকে সঙ্গ দেয়াই কী তাদের একমাত্র কাজ, নাকি অন্য পাঁয়তারাও আছে??
এসব
প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে ক্লাবে-হোটেলে ডিজে পার্টির চালচিত্র সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
নগরজীবনের
ব্যস্ততা ও নানাবিধ হতাশা ভুলতে অনেকেই ছুটছেন ডিজে ক্লাব পার্টিতে। এখানে
মিউজিকের তালে তালে এক মায়ানগরীতে ভাসে সবাই। বিশাল
স্পিকার থেকে ভেসে আসে বুক কাঁপানো সুর। কানে
হেডফো চোখের সামনে রাখা ডিস্ক প্লেয়ারে চলে ডিজেদের দক্ষ হাতের জাদু। আঙুলের
নিয়ন্ত্রণে চলে ভিন্ন ধরনের মিউজিকের খেলা। ডিস্ক
জকির বাজনার জাদুতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে নাচে এক দল মানুষ। এদের
বেশিরভাগই তরুণ। চোখ
ধাঁধানো আলো-আঁধারির খেলায় হারিয়ে যায় সব বেদনা ও হতাশা।
অভিযোগ
রয়েছে যে, মাদক পানীয় নির্ভর এসব পার্টিতে অংশগ্রহণের বয়সের কোনো বাছ-বিচার নেই । যে
কোনো বয়সের লোকজন, এমনকি কিশোর-কিশোরীরাও অনায়াসেই অংশ নিতে পারে উন্মাতাল পার্টিগুলোতে। এর
ফলে সামাজিক অবক্ষয় যেমন বাড়ছে, তেমনি অশানি সংকেত সৃষ্টি হচ্ছে পরিবারের মধ্যে। ড্যান্স
পার্টির উদ্যোক্তাদের বেপরোয়া তৎপরতায় অভিজাত এলাকার অভিভাবকরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন।
রাজধানীর
তেজগাঁওয়ের একটি ক্লাবের দোতলায় প্রতিসপ্তাহেই হট ডিজে পার্টির। নিচ
তলায়ও চলে হট ডিজে। সেখানে
ঢুকতে হলে টিকিট কাটতে হয়। জনপ্রতি
টিকিট ১ হাজার টাকা। টিকিট
কেটে ডিজে পার্টিতে ঢোকার পর দেখা যায় ভিন্ন এক চিত্র। এসব
ডিজে পার্টি আর ১০টা সাধারণ ডিজে পার্টি নয়। এখানে
উঁচু মঞ্চের ওপর কয়েকজন পুরুষ ডিজে কান ফাটানো শব্দে মিউজিক বাজায়। আর
মঞ্চের সামনে যুবক-যুবতীরা একে অপরের বাহুবন্ধনে উম্মাতাল হয়ে নাচে।
এসব
তরুণীকে নিয়ে নাচতে হলে নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিতে হয়। আর
চাহিদা মত টাকা দিলে বিশেষ বিশেষ অঙ্গও স্পর্শ করা যায়। প্রতিটি
পার্টিতেই আছে মদ আর বিয়ারের ছড়াছড়ি। এক
ক্যান বিয়ারের দাম এখানে ১০০০ টাকা। মদ
প্রতি পেগ ব্র্যান্ড ভেদে ১ থেকে ২ হাজার টাকা।
এখন
অভিজাত পাড়াগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই জমজমাট পার্টি ব্যবসা চলছে ঢাকার অনেকে জায়গায়। বহুতল
এ্যাপার্টমেন্ট ভবনের কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া করে এবং বিভিন্ন গেস্ট হাউসে নিয়মিতই চলছে রাতের জলসা। এরমধ্যে
বেশ কিছু চিহ্নিত গেস্ট হাউসকে মিনি পতিতালয় বললেও অতিরিক্ত বলা হবে না । ঢাকার পাশে
গাজীপুর এলাকার বিভিন্ন রিসোর্টেও চলছে ডিজে পার্টির নামে সেক্স ট্রেড। রিসোর্টগুলোর
আয়ের বড় অংশ আসে এ খাত থেকেই।
এবার
আসা যাক, ডিজে পার্টির প্রধান আকর্ষণ চিয়ার্স গার্লদের প্রসঙ্গে।
মিনি
স্কার্ট, টাইট জিন্স, পাতলা টি-শার্ট পড়ে ডিজে পার্টি জমিয়ে রাখা এসব চেয়ার্স গার্লদের ক্লাব বা হোটেলের মালিক পক্ষই নিয়োগ করে থাকে। এদের
মধ্যে আবার বিভিন্ন ক্লাস আছে। কেউ
স্থায়ী, কেউ অস্থায়ী। স্থায়ীরা
চুক্তিভিত্তিক টাকা পায়, আর যারা অস্থায়ী তারা ‘পার নাইট’ হিসেবে টাকা নেয়। ডিজে
পার্টিতে ড্যান্সের পাশাপাশি চিয়ার্সগার্লরা দেহ ব্যবসা ও মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত।
জানা
গেছে, অভিজাত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেদের অনেকেই গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করতে ডিজে পার্টিতে আসে। আবার
অনেকে আসে একাকী। একাকী
যারা আসে, তাদের জন্যই পার্টিতে থাকে চিয়ার্স গার্লরা।
পয়সাওয়ালা
পুরুষরাই থাকে চিয়ার্সগার্লদের মূল টার্গেট। আয়োজকরাই
ইশারায় চিয়ার্সগার্লদরে চিনিয়ে দেয় মালদার পুরুষকে। ব্যাস,
তাকে টার্গেট করেই এগিয়ে যায় একেকজন স্বল্পবসনা চিয়ার্সগার্ল। নাচের
নামে একটু একটু করে বাড়ায় ঘনিষ্ঠতা। দেহের
বিশেষ বিশেষ জায়গার ছোঁয়া দিয়ে পুরুষটির দেহমনে তৈরি করে পুলক। এরপরই
শুরু হয় বেড পার্টনার হওয়ার দর কষাকষি।
একই
সাথে চিয়ার্সগার্লরা জেনে নেয়, সে বাবা (ইয়াবা) নেয় কিনা? যদি উত্তর পজেটিভ হয় তাহলে তো পোয়াবারো। খুলে
গেল তার ব্যবসার নতুন দুয়ার। পেয়ে
গেল সে নিয়মিত খদ্দের। অভিযোগ
আছে, বেশিরভাগ চিয়ার্সগার্লই ইয়াবা আসক্ত। ফিগার
ঠিক রাখা আর ‘নাইট পার্টি’-তে হাজিরা দিতে রাত জাগার জন্য তারা নিয়মিতই ইয়াবা সেবন করে। এদের
অনেকেই আবার মাদক সিন্ডিকেটের ডিলার বা এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ডিজে
পার্টির আয়োজকদের অনেকের বিরুদ্ধে মাদক সিন্ডেকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে।
ওয়েস্টার্ণ
পোশাক পড়ে ডিজে পার্টিতে অংশ নিলেও চিয়ার্সগার্লরা যে উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে, এটা মনে করার কোন কারণ নেই। বরং
উল্টোটা। এদের
বেশির ভাগই মফস্বল থেকে আসা অস্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে। ঢাকায়
এসে তারা ওভারস্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে। অনেকে্ই
আবার স্বপ্ন দেখে মিডিয়ায় জায়গা করে নেয়ার। এ
জন্য তারা মর্ডান ড্যান্স শেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যায়। এসময়ই
ডিজে পার্টির আয়োজক বা তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়। মিডিয়ায়
সেইভাবে জায়গা করতে না পেরে তারা লুফে নেয় চিয়ার্স গার্ল হওয়ার অফার। পরে
ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে দেহ ও মাদক ব্যবসায়।
অনুসন্ধানে
জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে ডিজে পার্টির নামে চলছে রগরগে যৌনতা। অনেক
ক্লাবেই বিশেষ কিছু শয়ন কক্ষ আছে। যেখানে
পছন্দের তরুণীকে নিয়ে একান্তে কিছু সময় কাটানো যায়। এ
জন্য ক্লাব কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে ঘণ্টায় ১০ থেকে ১৬ হাজার টাকা। আর
তরুণী পান চুক্তি অনুযায়ী। এর
থেকে আবার ৫০ ভাগ চলে যায় মধ্যস্থতাকারীদের পকেটে।
নাম
প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রফেশনাল চিয়ার্স গার্ল বলেন, আসলে ইচ্ছে ছিল মিডিয়ায় কাজ করার। তাই
মর্ডান ড্যান্স শিখি। স্বপ্ন
ছিল মডেলিং করার। এজন্য
নিজের অনেক কিছুই বিলিয়ে দিয়েছি। মিডিয়াটা
প্রতারকদের আখড়া। আমার
সব নেওয়ার পর তারা কোনো কথা রাখে নি। তিনি
বলেন, এদিকে মডেল হওয়ার স্বপ্নে পরিবারের নিষেধ না শোনায় আমার হাতখরচ দেওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। পরিবার
থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। জিদ
করে একটা মেয়েদের হোস্টেলে উঠেছিলাম। সেখানেও
বিল দিতে না পারায় আমাকে বের করে দেয়া হয়। এরকম
একটা সংকটের সময়ে এক ড্যান্স টিচার আমাকে ডিজে পার্টিতে নিয়ে যায়। অস্তিত্বের
প্রয়োজনেই আমি চিয়ার্স গার্ল হয়েছি।
ওই
চিয়ার্স গার্ল আরো বলেন, প্রথম দিকে ডিজে পার্টিতে পার নাইট হাজার-বারো’শ পেতাম। এখন
পাই আড়াই থেকে তিন হাজার। ডিজে
পার্টি হয় গভীর রাতে। রাত
জাগার জন্য আর ফিগার ঠিক রাখার জন্য ইয়াবা খাওয়া শুরু করি। ইয়াবার
খরচ যোগাতে আমাকে অনৈতিক কাজও করতে হয়। তিনি
দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এরকম জীবন আমি চাই নি। এ
জীবন আমার ভালো লাগে না। কিন্তু
আমার তো বেঁচে থাকতে হবে। মিডিয়ার
লোকরাই আমাকে এ জীবনে ঠেলে দিয়েছে।
রাতভর
চলা ডিজে পার্টির রঙচঙে চিয়ার্স গার্লদের সিংহভাগের জীবন কাহিনী অনেকটা একই রকম, প্রেমিকের বাবাকে খুন করা লাবনী আক্তার কনিকার জীবনটাও ছিল এরকমই।