নারিকেলের খোল বা মালা এখন আর ফেলনা নয়। এই খোল দিয়ে মাগুরা শহরতলির বরুনাতৈল গ্রামের আবদুল হান্নান বাণিজ্যিকভিত্তিতে তৈরি করছেন বিভিন্ন ডিজাইনের বোতাম মহিলাদের নানা রকম অলঙ্কার। শিল্প থেকে হান্নান নিজে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি তার কারখানায় বোতাম তৈরির কাজ করে এলাকার নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। হান্নান জানান, ঢাকার গার্মেন্টসহ বিভিন্ন দোকানে চীন থেকে আমদানি করা কাঠের বোতাম দেখে সর্বপ্রথম তার এই উদ্ভাবনী চিন্তা মাথায় আসে। তখন তার হাতে যথেষ্ট পুঁজি ছিল না। কারণে এক রকম ঝুঁকি নিয়েই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কৃষক শেখ হান্নান বছর আগে সামান্য এক টুকরো জমি বিক্রি করে কিনে আনেন বোতাম তৈরির ৭টি মোটরচালিত ড্রিল মেশিন।
বসতবাড়ির একটি কক্ষে সাত মহিলা শ্রমিক নিয়ে শুরু হয় তার যাত্রা। প্রথম চালানেই ঢাকার বেশ কিছু গার্মেন্টে সুনাম অর্জন করে তার তৈরি করা বোতাম। এরপর কঠোর পরিশ্রম তার এই পথচলাকে আর বিস্তৃত করে।
এখন তার বাড়িতে বসেছে ১৬টি মেশিন। সেখানে প্রতিদিন কাজ করছেন এলাকার দরিদ্র পরিবারের ১৫ থেকে ২০ মেয়ে গৃহবধূ। আর তাদের হাতে প্রতি মাসে তৈরি হচ্ছে তিন থেকে চার লাখ বোতাম।
শুধু বোতাম নয়, বোতাম তৈরির পর যে অতিরিক্ত অংশ থাকে তা থেকে তৈরি হচ্ছে মহিলাদের ব্যবহার উপযোগী সুদৃশ্য কানের দুল। বোতাম অলঙ্কার তৈরির পর নারিকেলের খোলের বাকি অংশ সরবরাহ করা হচ্ছে ঢাকা, ময়মনসিংহ, ভৈরবসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা মশার কয়েল কারখানায়।
হান্নান জানান, নারিকেলের খোল থেকে বোতাম তৈরির জন্য প্রথমে ড্রিল মেশিন দিয়ে বোতামের সাইজ অনুযায়ী নির্দিষ্ট বৃত্তাকারে পৃথক করা হয়। পরে অপর ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করা হয়। এরপর ফিনিশিং।
এখানে কর্মরত মহিলারা জানান, নিজ গৃহে কাজ করার পর কারখানায় ছয় থেকে সাত ঘণ্টা শ্রম দিয়ে প্রতিদিন তারা গড়ে থেকে হাজার বোতাম তৈরি করে মাসে থেকে হাজার টাকা আয় করে থাকেন। গৃহবধূ পারভিনা বেগম জানান, তার স্বামীর একার আয়ে পরিবার সচ্ছলভাবে চলে না। এখানে বোতাম তৈরির কাজ করে যে টাকা পান তা থেকে তার সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তিনি আরও জানান, প্রতিদিন সংসারের কাজের ফাঁকে গড়ে - ঘণ্টা সময় এখানে অনায়াসেই দেয়া সম্ভব। তার মতো কর্মরত মহিলাদের প্রত্যেকেরই মতামত একই রকম।
ব্যাপারে শেখ হান্নান জানান, বাগেরহাট জেলা স্থানীয়ভাবে ভাঙাড়ি বিক্রেতাদের কাছ থেকে নারিকেলের খোল কিনে তিনি বোতাম তৈরির কাজ করে থাকেন। প্রথম প্রথম খোলের দাম কম থাকলেও এখন সঙ্কটের কারণে প্রতি কেজি খোল ছয় টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। প্রতি এক হাজার নারিকেলের খোল থেকে ছোট বড় সাইজের ৩০ থেকে ৫০ হাজার বোতাম তৈরি হয়। যার উৎপাদন খরচ থেকে হাজার টাকা। বড় সাইজের প্রতি হাজার বোতাম প্রকারভেদে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা কমন সাইজের শার্টের বোতাম ১২০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।
তার তৈরি বোতাম ঢাকার বিভিন্ন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, সদরঘাটের পাইকারি বাজার পাটের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্রের কারখানায় বিক্রি হয়ে থাকে। এছাড়া বায়াররা কিনে বিভিন্ন দেশে রফতানি করে থাকে বলে হান্নান জানান।
তিনি বলেন, ‘পুঁজি সঙ্কটের কারণে তার কারখানার পরিধি বাড়াতে পারছেন না। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে খুব সহজেই শিল্পে বড় ধরনের বিস্তৃতি ঘটানো সম্ভব।হান্নান বলেন, ‘সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে বোতাম আমদানির প্রয়োজনীয়তা হ্রাসসহ কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।
নারিকেলের খোল থেকে বোতাম তৈরির প্রয়োজনীয় সামগ্রী
সম্ভাব্য পুঁজি : ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা।
সম্ভাব্য লাভ : বোতাম বিক্রি হয় ছোট-বড় প্যাকেট হিসেবে। হাজার বোতামের এক প্যাকেট বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। হাজার বোতাম উৎপাদনে খরচ হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
সুবিধা : নারিকেলের খোল দিয়ে বোতাম তৈরির পাশাপাশি অব্যবহৃত অংশ দিয়ে মশার কয়েল তৈরি করা সম্ভব, যা মশার কয়েল তৈরির কারখানায় বিক্রি করা হয়। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে তৈরি জ্যাকেট, শার্ট, প্যান্টসহ বিভিন্ন পোশাকে বোতাম ব্যবহৃত হয়। এর চাহিদা রয়েছে প্রচুর।
যা প্রয়োজন : নারিকেলের খোল, ড্রিল মেশিন মসৃণ করার মেশিন।
প্রস্তুত প্রণালি : পোশাক কারখানা রয়েছে এমন জায়গায় কারখানা স্থাপন করলে পরিবহন খরচ কমবে। নারিকেলের বোতাম বানানোর প্রধান উপকরণ হচ্ছে নারিকেলের খোল। নারিকেলের খোল বা মালা মেশিনের সাহায্যে সাইজ মতো কেটে নিতে হয়। এরপর ছিদ্র করে নিলেই তৈরি হয় বোতাম। গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে মসৃণ করে নিলেই তৈরি হয়ে গেল নারিকেলের মালার বোতাম।
বাজারজাতকরণ : পোশাক তৈরি প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্ট, বায়িং হাউসগুলো এর প্রধান ক্রেতা। যোগাযোগের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করা যায়।
যোগ্যতা : বিশেষ কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে না। আগ্রহীরা মাগুরা জেলার সদর থানার বরুনাতৈল গ্রামের আবদুল হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
- আনোয়ার হোসেন শাহীন : মার্চ ২৫, ২০১৪          
 
Top