একের পর এক পরকীয়া। কখনো
স্বামীকে বিদেশে রেখে, কখনো স্বামীর সঙ্গে থেকেই তার অগোচরে। শেষ
পর্যন্ত প্রেমের পথের বাধা দূর করতে ‘হত্যা’ করা হয় ‘কথিত’ দ্বিতীয় স্বামীকে।
দীর্ঘ
আড়াই বছর আগে ঘটে এই হত্যাকাণ্ড। তারপর
লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল জড়িতরা। দীর্ঘদিন
ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সংসার করেছে একসঙ্গে।
কিন্তু
এই মামলার ক্লু উদঘাটনে ব্যর্থ হয় থানা পুলিশ। চূড়ান্ত
প্রতিবেদন পাঠানো হয় আদালতে। শেষ
পর্যন্ত তদন্তে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই’র অভিযানে মো. ইব্রাহিম ও আলেয়া আক্তার আলোকে গ্রেপ্তারের পর জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ইতিমধ্যে
১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিও দিয়েছে আলো।
আলোর
জীবনে এসেছে তিন পুরুষ। তারমধ্যে
একজনকে জীবন দিতে হয়েছে। নিহত
মির্জা শাকিলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কৈশোর থেকেই। ঢাকার
দোহারের দক্ষিণ জয়পাড়ার মির্জা পরিবারের ছেলে শাকিল। একই
গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে আলো। একই
এলাকায় বসবাসের সুবাদে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে তাদের। এরমধ্যেই
আলেয়ার বিয়ে হয় সিঙ্গাপুর প্রবাসী কোরবান খানের সঙ্গে। কিন্তু
প্রেমের পথে এই বিয়ে কোনো বাধা হতে পারেনি। কোরবান
খান দেশের বাইরে যাওয়ার পর শাকিল ও আলোর সম্পর্ক আরো গভীর হয়। ঢাকার
বিভিন্নস্থানে চুটিয়ে প্রেম করতো তারা। স্বামী
বিদেশে থাকায় এতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।
এরমধ্যে
দুটি সন্তানের জন্ম হয় আলোর গর্ভে। সন্তান,
সংসার কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি শাকিলের প্রেম থেকে। যদিও
পাড়া-প্রতিবেশীদের সমালোচনার শিকার হচ্ছিলো এই প্রেমিকজুটি। ২০১৫
সালের শেষের দিকে এক সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে দোহার থেকে প্রেমিকের হাত ধরে ঢাকায় আসে আলো। মির্জা
শাকিলের সঙ্গে ঘর বাঁধে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী এলাকায়। ইতিমধ্যে
আগের স্বামীকে ডিভোর্স দেয়। কিন্তু
ডিভোর্স লেটার তাকে পাঠানো হয়নি।
যাত্রাবাড়ীতে
শাকিলের ভাড়া বাসাতে সাবলেট হিসেবে উঠে তার বন্ধু ইব্রাহিম। মাদারীপুরের
শিবচরের মাতবরের চর গ্রামের ইব্রাহিম থাকতো ঢাকার বড় মগবাজারের চেয়ারম্যান গলিতে। মাদকসহ
নানা অপরাধে জড়িত ইব্রাহিম। সাবলেট
থাকার সুবাধে অল্পদিনেই শাকিলের প্রেমিকা কথিত স্ত্রী আলোর দিকে নজর পড়ে ইব্রাহিমের। সাড়া
দেয় আলোও। শাকিলের
অলক্ষ্যে জন্ম হয় আরেকটি পরকীয়া প্রেমের।
আদালতে
দেয়া আলোর স্বীকারোক্তি অনুসারে, রাত-বিরাতে তাদের বাসায় হতো মদের আড্ডা। মদ
পান করতো ইব্রাহিম, শাকিল ও আলো। মদ
পান করিয়েই ‘হত্যা’ করা হয় শাকিলকে। ২০১৬
সালের ২৫শে জানুয়ারি রাতে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ওই বাসায় শুরু হয় মদের আড্ডা। এতে
শাকিল, ইব্রাহিম, আলো ছাড়াও অংশ নেয় ইব্রাহিমের বন্ধু রবিন ও নাহিদ। রাত
২টার দিকে রবিন, নাহিদ চলে যায়। এদিকে,
আড্ডা শেষ হতে না হতেই অসুস্থ হয়ে যায় শাকিল। একের
পর এক বমি করতে থাকে। মুখ
দিয়ে লালা বের হয়।
আলো
জানিয়েছে, ২৭শে জানুয়ারি শাকিলকে একটি ওষুধ সেবন করায় ইব্রাহিম। তারপর
শাকিলের অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। এসময়
বাইরে থেকে কেচি গেইট বন্ধ করে পালিয়ে যায় ইব্রাহিম। শাকিলের
অবস্থা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে গেলে চিৎকার করে কান্না করছিলো সে। এসময়
আশেপাশের লোকজন বাসার কেচি গেইটের তালা ভেঙে দিলে শাকিলকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যায় আলো।
অবশ্য
পিবিআই’র তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক হুমায়ূন ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই শাকিলের মৃত্যু হয়েছে। শাকিলের
লাশ ঢামেকে রেখে ইব্রাহিমের সঙ্গে পালিয়ে যায় আলো। শাকিলকে
‘হত্যা’র পর ঢাকাতেই স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করতো আলো ও ইব্রাহিম। মগবাজারের
বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থেকেছে প্রায় ছয় মাস। তারপর
ইব্রাহিমের সঙ্গে সম্পর্ক টিকেনি। এই
সম্পর্কের ইতি টেনে প্রথম স্বামী প্রবাসী কোরবানের কাছে ফিরে যায় আলো ওরফে আলেয়া।
শাকিলের
পিতা নুরুল ইসলাম জানান, শাকিলের লাশ ঢামেক হাসপাতালে রেখে যাওয়ার পরপরই অজ্ঞাত একজন ফোনে জানায় তার ছেলের লাশ ঢামেকে। খবর
পেয়ে তিনি ছুটে যান সেখানে। নিহত
শাকিলের মুখ দিয়ে তখনও লালা ঝরছিলো।
নুরুল
ইসলাম অভিযোগ করেন, তার ছেলেকে মদের সঙ্গে বিষাক্ত বা ওষুধ জাতীয় কিছু সেবন করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ
বিষয়ে হত্যার অভিযোগে ২০১৬ সালের ৮ই মার্চ যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন নুরুল ইসলাম। ওই
মামলায় থানা পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে পুনরায় তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। গত
২৮শে এপ্রিল সকালে দোহারের দক্ষিণ জয়পাড়ার কোরবান খানের বাড়ি থেকে আলেয়া ওরফে আলোকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তার
দেয়া তথ্যানুসারেই পরদিন ধোলাইপাড় থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ইব্রাহিমকে।
পিবিআই’র বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কালক্ষণ উল্লেখ নেই। তবে
সুরতহাল প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের বর্ণনানুসারে তা হত্যাকাণ্ড বলেই মনে হচ্ছে। এ
বিষয়ে আরো তদন্ত প্রয়োজন। এজন্য
ইব্রাহিমকে দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।