প্রথমে
নেহাতই কৌতূহল। বন্ধুদের
কাছ থেকে চেয়ে এক-দু্ই টান দেওয়া। একসময়
কৌতূহল পরিণত হয় মরণ নেশায়। এমনটাই
ঘটেছে তানিয়ার (ছদ্মনাম) ক্ষেত্রে। রাজধানীর
এক নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানিয়া বন্ধুদের আড্ডায় অন্য মেয়েবন্ধুদের থেকে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের জন্য ছেলেদের সঙ্গে সিগারেটে আসক্ত হয়। ধীরে
ধীরে সে আসক্ত হয় ইয়াবায়।
শুধু
তানিয়া একা নন, দেশের অনেক নারীই এখন মাদকসেবী। দিন
দিন বাড়ছে এ সংখ্যা। কখনো
রাগ, কখনো ক্ষোভ, আবার অভিমান থেকে মাদকাসক্ত। কেউ
আবার শুধুই কৌতূহল, কিংবা বন্ধুর সঙ্গে পা বাড়িয়ে দেন এই অন্ধকারজগতের দিকে। বাংলাদেশের
মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ সরাসরি মাদকাসক্ত। তাদের
মধ্যে ৮৭ শতাংশ পুরুষ ও ১৩ শতাংশ নারী।
মাদকসেবীদের
মধ্যে যদিও পুরুষদের সংখ্যাই বেশি, তবে নারীরাও খুব একটা পিছিয়ে নেই। বাদ
পড়ছেন না কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারাও। মাদকদ্রব্য
নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ২০১৭ সালের (জুন পর্যন্ত) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে নারী মাদকসেবীর সংখ্যা ৫ লাখ ৯০ হাজার। এর
মধ্যে ইয়াবায় আসক্ত ৩০ শতাংশ, অর্থাৎ ১ লাখ ৭৭ হাজার, যাদের বয়স ১৬ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। মানসিক
হতাশা, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারা, সহপাঠীর প্ররোচনায় এবং প্রেম বিচ্ছেদের কারণে ইয়াবায় আসক্ত হয়েছেন তারা।
জানতে
চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. মানজুরুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৭ সালের ডাটা তৈরির কাজ শেষ। কয়েক
দিনের মধ্যেই আমরা পুরো প্রতিবেদন প্রকাশ করব।’ তিনি
জানান, মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নারীদের আবাসিক কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি
পর্যায়ে কিছু রয়েছে। ফলে
সারা দেশে নারী মাদকাসক্তের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নারীরা মূলত বেশি আসক্ত ইয়াবায়। বিশেষ
করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ সংখ্যা বেশি। আর
যারা রাত জেগে কাজ করেন, ক্লান্তি এড়াতে চান, তাদের মধ্যে ইয়াবার চাহিদা বেশি। কারণ
তারা মনে করেন, ইয়াবা শক্তি বাড়ায়। ঘুম
কমায়। ক্ষুধামন্দা
দেখা দেয়। ফলে
কাজের স্পৃহা বাড়ায়। কিন্তু
যখন ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ইয়াবা ছাড়তে চান, তখন আর থাকতে পারেন না।
জ্বর,
ডায়রিয়া, খিঁচুনি দেখা দেয়। ফলে
নেশায় একবার জড়িয়ে পড়লে, পরে নেশা থেকে আর বের হওয়ার উপায় তাদের হাতে থাকে না। নারী
মাদকসেবীদের নিয়ে একই অভিমত ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের নারী মাদকাসক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রেরও। তাদের
জরিপ (২০১৭) অনুযায়ী, নারী মাদকাসক্তদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ ইয়াবাসেবী। মাদক
হিসেবে ঘুমের ওষুধ নেন ৩৩ শতাংশ নারী, সিগারেট ৩২ শতাংশ, মদ ২৮ শতাংশ, গাঁজা ২৬ শতাংশ, ফেনসিডিল ৯ শতাংশ, হেরোইন ৫ শতাংশ, পেথেড্রিন নেন ৩ শতাংশ নারী।
জরিপে
অংশ নেওয়া ৯৫ জনের পরিবারের মধ্যে ১৬ শতাংশের স্বামী, ৪ শতাংশের বাবা, ১৬ শতাংশের ভাই, ৪ শতাংশের বোন এবং ২ শতাংশের মা মাদকাসক্ত ছিলেন। এ
ছাড়া ৩৪ শতাংশ নারীর একাধিক যৌনসঙ্গী আছে এবং ৪৪ শতাংশের অনিরাপদ যৌন অভিজ্ঞতা আছে। তাদের
১১ শতাংশ মাদক-সংক্রান্ত মামলায় জড়িত। জানতে
চাইলে আহ্ছানিয়া মিশন মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার উম্মে জান্নাত বলেন, নারী মাদকাসক্তদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ছোটবেলা থেকে সে যে পরিবেশ থেকে বড় হয়, সেই পরিবেশের একটা প্রভাব থাকে। কিছুটা
বংশগত প্রভাব থাকে। বন্ধুদের
কাছ থেকেও আসক্ত হতে পারে। অনেক
ক্ষেত্রে আবার পরিবার থেকে দূরে থাকাও একটা অন্যতম একটা বড় কারণ।
মাদক
পাচারে জড়িত ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ নারী : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কর্মকর্তাদের মতে, ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ নারীকে মাদক পরিবহনে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু
রাজধানীতেই অন্তত ৫০টি এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন নারী মাদক ব্যবসায়ীরা। নারীর
স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ইয়াবা বা গাঁজা পরিবহন করা হয়। ফলে
এদের আটক করতে বেশ বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। এ
কারণেই মাদকের মূল হোতাদের প্রধান লক্ষ্য নারী। এ
ব্যাপারে মো. মানজুরুল ইসলাম বলেন, ইয়াবা ছোট ট্যাবলেট হওয়ায় বহন করা সহজ। নারীদের
দিয়ে সহজেই পাচার করা যায়। তাই
মাদক ব্যবসায়ীরা নারীদের বেশি করে টার্গেট করছে।
আবার
মাদকাসক্ত নারীরাও নেশার টাকা জোগাড় করতে ব্যবসায়ীদের তৈরি এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন।
রাজধানীতে
রয়েছে কয়েকশ ম্যানেজ কর্মী : রাজধানীতে শুধু ইয়াবা বিক্রি নয়, নতুন নতুন ক্রেতা সংগ্রহের জন্য রয়েছে কয়েকশ ম্যানেজ কর্মী, যাদের প্রধান কাজ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে তরুণ-তরুণীদের ম্যানেজ করে ইয়াবা সেবনে উৎসাহিত করা। যে
যত বেশি ম্যানেজ করতে পারবেন তার কমিশন তত বেশি। এ
তথ্য জানিয়েছেন ২০ বছর ধরে মাদক ব্যবসায়ী মিনারা (৪২)। ৮
ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কারওয়ান বাজার রেলওয়ে বস্তি এলাকা থেকে মিনারা ওরফে শাহনাজ বেগম ওরফে দিলারাকে গ্রেফতার করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো উপ অঞ্চলের (উত্তর) সহকারী পরিচালক মো. খুরশিদ আলম। মাদকের
সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নিউমার্কেট থানায় মিনারার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৭টি। এ
ছাড়া তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে।