গতবছর
মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের মুকুট মাথায় উঠেছিল জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের মাথায়। হয়তো
তিনি বিশ্ব মঞ্চ আলোকিত করতে পারতেন কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় যখন সামনে আসে এভ্রিলের বাল্যবিয়ের খবর। শনিবার
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল- চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের জাগো বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো নিজের বাল্যবিয়ের ঘটনা তুলে ধরলেন এভ্রিল। মোশাররফ
করিমের সঞ্চালনায় আরও কয়েকজন সম্ভাবনাময়ী বাল্যবিয়ের শিকার তরুণীও ছিলেন।
জান্নাতুল
নাঈম বলেন, মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার কথা তো সবাই জানেনই। ওখানে
কোথাও উল্লেখ ছিল না, প্রতিযোগীর স্ট্যাটাস কি, সিঙ্গেল, ডিভোর্সি নাকি ম্যারিড! ওখানে কোথাও লেখা ছিল না যে, বাল্য বিবাহিত বা বাল্য ডিভোর্সি। এ
ধরনের কোনও অপশন ছিলো না সেখানে।
তিনি
বলেন, আমি কারো কাছে কখনো প্রতারক হতে চাইনি। আমি
মিথ্যা খুবই কম বলি। আর
যেখানে বাংলাদেশের আইনে বলা আছে, বাল্য বিবাহটা কোনো বিয়েই না। তাহলে
আমি এটাকে বিয়ে কেন মানবো? কেন আমাকে সবাই প্রতারক সুন্দরী বলে ডাকবে? কেন? কথাগুলো বলার সময় এভ্রিলের কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
এভ্রিল
বলেন, ছোটবেলা থেকে খুব বেশি ডানপিটে ছিলাম আমি। বাবার
সঙ্গে শৈশব থেকে আমার বন্ধনটা ছিল অন্যরকম। আমরা
চার ভাইবোন। আমার
মনে হতো, ওই সময় বাবা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, আমাকেই প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু
এসএসসি পরীক্ষার একমাস পর একদিন শুনলাম, আমাকে দেখতে আসবে। হাতে
আংটি পরিয়ে দেবে। আমি
তো শুনে রেগে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। সেই
সময় আমার বয়স ছিলো ১৬ বছর। বিয়ের
কথা শোনার পর কেঁদে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু
আমাকে ধরে আনা হলো।
তিনি
বলেন, সবাই জানালো, এখন আমাকে আংটি পরাতে আসবে। তখন
বাবার কাছে জানতে চাইলাম, কেন আমাকে বিয়ে দিতে চাইছো? বাবা বললো, ‘দেখো, তুমি মেয়ে হয়ে জন্মেছো, আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। আমার
মেয়েকে আমি বিয়ে দেবো, আমার দায়িত্বটা শেষ করবো’।
তখন
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে বিয়ে দিলেই তোমার দায়িত্ব শেষ? তিনি জোর গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, শেষ’। তখন বাবার
পা ধরে খুব কেঁদে বলছিলাম, বিয়ে করবো না। পড়ালেখা
করবো। কিন্তু
তিনি কিছুতেই শুনছিলেন না। মনে
হচ্ছিল, বাবা পাষাণ হয়ে গিয়েছিলেন!
এভ্রিল
বলেন, এটারও কারণ আছে বলে জানান এভ্রিল। বিশেষ
করে গ্রামাঞ্চলে মধ্যবিত্ত পরিবারে সুন্দরী বা লম্বা মেয়ে থাকলে চারপাশের মানুষগুলো অনেক ডিস্টার্ব করে। মানুষ
বাবাকে যে চাপ দিচ্ছিল তা নিতে পারছিলেন না তিনি। যদি
আমাকে কেউ তুলে নিয়ে যায়, এই ভয় ধরে বসেছিল তাকে। মান-সম্মান নিয়ে খুব ভয় পান তিনি।
এভ্রিল
বলেন, তখন বাবাকে একটা কথা বলেছিলাম, তুমি তোমার দায়িত্ব শেষ করো ঠিক আছে কিন্তু আজ থেকে তুমি আমার বাবা না। ছোটবেলা থেকে
তোমার সঙ্গে আমার এত ভালোবাসার সম্পর্ক, অথচ আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছো না, আমার স্বপ্নগুলো পূরণ করার কথা তুমি একবারও ভাবছো না, শুধু সমাজের কথা চিন্তা করে একটা ছোট মেয়েকে তুমি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো। তোমার
মেয়ের নিরাপত্তা দিতে পারছো না বলে বিয়ে দিচ্ছো, সেক্ষেত্রে তুমি আমার বাবা হতেই পারো না। তার
সঙ্গে আমার শেষ কথা ছিল এটুকুই।
জান্নাতুল
নাঈম এভ্রিল বলেন, তারপর বিয়ে করে ফেলি। বিয়ের
সময় আমি মাকে বলি, মা আমি সুইসাইড করবো। আমি
মরে যাবো। মা
আমাকে কানে কানে বলেছিলেন, তুই শুধু বেঁচে থাকবি আমার জন্য। যদি
তুই কালকে মরে যাস, তাহলে কিন্তু কবরে একটা লাশ যাবে না, যাবে দুইটা লাশ! কারণ আমি তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।
তিনি
বলেন, একটা মেয়ে একা একা ঘর থেকে বের হয়ে আসা। তার
কোনো সাপোর্ট নেই। সে
কিভাবে পড়ালেখা করবে। সমাজের
মানুষের কথা শুনতে হচ্ছে। স্ট্রাগল
করা অনেক বেশি কঠিন একটা মেয়ের জন্য। আমার
আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে শুধু আমার পরিশ্রম নয়, মায়ের পরিশ্রম নয়, আশেপাশের আরো কয়েকটা মানুষের অনেক সাপোর্ট ছিলো।
অতীত
নিয়ে ভাবতে চান না উল্লেখ করে এভ্রিল বলেন, আমি অতীত নিয়ে ভাবতে চাই না। শুধু
এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে চাই। সারাজীবন
আর শেষ নিঃশ্বাস অবধি স্বপ্ন দেখতে চাই। স্বপ্ন
দেখা বন্ধ করা যাবে না। মানুষ
তখনই ফুরিয়ে যায়, শেষ হয়ে যায়, যখন সে স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায়। ওইসব
সমাজকে দেখিয়ে দিতে চাই, যারা একটা মেয়ের বয়স নিয়ে ভাবে না, তার বিয়ে হলে কী ঘটতে পারে তা চিন্তা করে না, যারা শুধু দারিদ্র, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন দিক চিন্তা করে মেয়েটাকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠালেই যেন বোঝা শেষ।
মোশাররফ
করিম মন দিয়ে এভ্রিলের কথা শোনেন। এরপর
বলেন, আমি চাই বাল্যবিয়ের কারণে তোমার (এভ্রিল) বেদনাটা ছুঁয়ে যাক দর্শকের মনকে। যেন
দর্শকও ব্যথিত হন আর সবার টনক নড়ে। এভ্রিলের
বাবা তার মেয়েকে ভালোবাসতেন। সেখানে
সমস্যা ছিল না। কিন্তু
এভ্রিলকে বিয়ে না দিলে কী কী ঘটতে পারে, সেইসব ভয় যে তাকে দেখানো হলো, সেই ভয় থেকে তিনি সরতে পারলেন না।
তিনি
বলেন, সেই ভয়ের উৎসটাকে তাড়ানো সবচেয়ে জরুরি। যেখান
থেকে আমি স্বাধীনভাবে বলতে পারবো- আমি এই হতে চাই, আমাকে হতে দাও। আমাকে
ভয় দেখিও না। কারণ
আমি, এভ্রিল, আমরা যারা এ দেশের মানুষ, এ দেশের সন্তান, তারা প্রত্যেকেই এ দেশের সম্পদ। তাদেরকে
হয়ে উঠতে দিতে হবে। তাই
ভয়কে তাড়াতে হবে।
এদিন,
জাগো বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে বাল্যবিয়ে নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হয়।