‘‘দেশের ফুটবল অ্যাকাডেমিগুলিতে বিদেশি কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারের সংখ্যা ৩০ শতাংশে বেঁধে দেওয়া উচিত, এতেই সুরক্ষিত থাকবে ‘আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য’। ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই এই সংরক্ষণ চালু করা উচিত। এ ভাবেই জাতীয় দলে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা কমাতে পারব আমরা।’’ ইউরো ও বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি সুইপার লঁরা ব্লাঁ-এর এই প্রস্তাব স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেয়নি ফরাসি ফুটবল সংস্থা। উল্টে বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের দায়ে দেশজোড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি।
মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন লঁরা ব্লাঁ । তবে পরিস্থিতি পাল্টায়নি। যুদ্ধের পৃথিবীতে ইউরোপে আছড়ে পড়ছে উদ্বাস্তুর ঢল। উদ্বাস্তুর ঢল আরও বেশি করে আছড়ে পড়ছে ফুটবল মাঠে। কখনও যুদ্ধের জন্য ঘরছাড়া, কখনও বা স্রেফ ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে ক্লাব বদলের মত দেশবদল। আরও বেশি করে মিলে যাচ্ছে মহাদেশ, ভাঙছে সীমান্ত, বদলে যাচ্ছে জার্সির রং। সেই রঙে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে বিশ্বকাপ।
ক্রয় করুন http://www.bongshi.org থেকে
‘অভিবাসী’ ফুটবলারদের ইউরোপের দেশের হয়ে খেলা আটকে দেওয়া এখন অনেক দূরের কথা। উল্টে বলা যেতে পারে, তাঁদের হাত ধরেই ইউরোপ এখন বিশ্ব ফুটবলের ভাগ্যবিধাতা। রাশিয়া বিশ্বকাপে ইউরোপের প্রধান দশটি দেশের ২৩০ জন ফুটবলারদের মধ্যে ৮৩ জনই ‘অভিবাসী’ ফুটবলার। ফরাসি ফুটবল দলের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা আরও আকর্ষণীয়, ৭৮.৩ শতাংশই সেখানে অভিবাসী। জাতীয় দলে অভিবাসী ফুটবলারদের সংখ্যায় ফ্রান্সের খুব কাছেই আছে ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড।

অভিবাসীরা সবাই যে আশ্রিত দেশের হয়ে খেলছেন, এমনটা নয়। সুইডেনেই জন্ম, সুইডেনের অ্যাকাডেমিতেই ফুটবলে হাতেখড়ি। ২০১৭-তে সুইডেনের জার্সি গায়েই আন্তর্জাতিক ফুটবলে পা রাখেন প্রতিভাবান স্ট্রাইকার সামান ঘোদ্দোস। বিশ্বকাপের মূলপর্বে ইরান যোগ্যতা অর্জন করার পরই তাঁকে ফোন করেন ইরানের জাতীয় ফুটবল দলের ম্যানেজার। ঘোদ্দোস আপাদমস্তক সুইডেনে বড় হলেও তাঁর বাবা-মা ইরানি। ঘোদ্দোস ইরানে দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী। সেই খবর পৌঁছেছিল তেহরানে। তারপরই ডাক আসে ইরানের হয়ে খেলার। আর তাতে সাড়া দেন ঘোদ্দোস। ২০১৭-তেই জীবনে প্রথম বার ইরানে পা রাখেন তিনি আর  রাশিয়া বিশ্বকাপে তাঁকে খেলতে দেখা যায় ইরানের হয়েই। সুইডেনের হয়ে খেলার প্রস্তাব এলেও তা ফিরিয়ে দেন তিনি। ঘোদ্দোস যদিও জানাচ্ছেন, ‘‘আমার শোবার ঘরে দু’টি জাতীয় পতাকা টাঙানো থাকে। একটি সুইডেনের, অন্যটি ইরানের। আমার কাছে এটা ক্লাব পছন্দ করার মতো একটা কিছু, তার বেশি না।’’
পেপে, দিয়েগো কোস্তার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা আবার অন্য রকম। দু’জনেরই জন্ম, বেড়ে ওঠা ব্রাজিলে। ফুটবল পাঠও সেখানেই। তবে দেশের হয়ে খেলার প্রশ্নে কোথাও ব্রাজিল নেই। দিয়েগো কোস্তা খেলেন স্পেনে। পেপে আবার গায়ে নিয়েছেন পর্তুগালের জার্সি। ইউরোপের দেশগুলিতে ব্রাজিলের ফুটবলারদের অনুপ্রবেশ আটকাতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন প্রাক্তন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটার। তবে আইনি জটিলতা কাটিয়ে তা বেশি দূর এগোয়নি। ইউরোপীয় দেশগুলির উদার অভিবাসন নীতি এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

প্রতিটা পরিস্থিতি আলাদা হলেও মিল একটা জায়গাতেই। দেশের হয়ে খেলা এখন অনেকটাই ক্লাব খেলার মত। একাধিক ক্লাবে খেলার মত অনেক ফুটবলারই এখন বিভিন্ন দেশের হয়ে খেলেন।
এ ক্ষেত্রে সামনে আসে বোয়াতেং ভাইদের কথা।
ঘানা থেকে জার্মানিতে শরণার্থী হয়ে এসেছিল বোয়াতেং পরিবার। দুই ভাই কেভিন আর জেরোম, জার্মানিতে দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী। দু’জনেই প্রতিভাবান ফুটবলার। বড়ভাই কেভিন অনূর্ধ্ব ১৫ আর ২১ জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। অনূর্ধ্ব ২১ দলের হয়ে খেলে জার্মানিকে ইউরো চাম্পিয়নও করেন। সেই দলে তাঁর সতীর্থ ছিলেন ওজিল, ন্যয়ার, খেদিরা ও হামেলস। এককথায় জার্মানি ফুটবলের সোনার প্রজন্মের অংশীদার। কিন্তু শিবির চলাকালীন এক বার নাইট ক্লাবে যাওয়ায় তাঁকে সাসপেন্ড করে জার্মান ফুটবল ফেডারেশন। কালবিলম্ব না করে কেভিন চলে যান ঘানায়। খেলতে শুরু করেন ঘানার জার্সি গায়ে। ভাই জেরোম থেকে যান জার্মানিতেই। ব্রাজিলে ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি হয় জার্মানি আর ঘানা। একদলে জেরোম বোয়েতাং, অন্য দলে দাদা কেভিন। একই বাড়িতে বড় হওয়া দুই ভাই মুখোমুখি বিশ্ব ফুটবলের শ্রেষ্ঠ মঞ্চে, এই ঘটনা চাক্ষুষ করে ফুটবল বিশ্ব।

তবে পুরোটাই স্বপ্ন উড়ান, এমনটা নয়। আশ্রিত দেশে অনেক সময়ই লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। ঘরছাড়া মানুষদের জন্য পৃথিবীটা কখনই খুব সহজ নয়। কঙ্গো বংশোদ্ভুত বেলজিয়ামের স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু এনিয়ে মাঝেমধ্যেই সরব হন। বেলজিয়ামের সংবাদমাধ্যম তাঁকে কী নজরে দেখে, সে সম্পর্কে তিনি এক বার বলেছিলেন, ‘‘আমি ভাল খেললে ওঁরা বলেন, বেলজিয়ামের স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু। কোনও দিন ভাল খেলতে না পারলে ওঁরা বলেন, বেলজিয়ামের ঘানা-বংশোদ্ভূত স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু।’’
বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম মহানায়ক জিনেদিন জিদান বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন ফুটবলের শ্রেষ্ঠ মঞ্চ বিশ্বকাপের ফাইনালে। আলজেরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পর তাঁর বাবা-মা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ফ্রান্সে। ফ্রান্সকে বিশ্ব ফুটবলের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলি তুলে দেওয়ার পরেও আলজেরিয়ার অতীত কিন্তু তাঁর পিছু ছাড়েনি। ফাইনালে জিদানকে মাঠ থেকে বের করে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। আর সে জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল তাঁর অতীতকেই। উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল ইতালির। কিন্তু জিদান মাতেরাজিকে মাথা দিয়ে গুঁতোলেও আজও ক্ষমা চাননি কোথাও। উল্টে বলেছেন, যা করেছেন, ঠিক করেছেন। আলজেরীয় উদ্বাস্তু পরিবারে বড় হওয়া, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সব থেকে ছোট জিদানের কাছে ফুটবল মাঠই ছিল সবথেকে স্বস্তির জায়গা। সেই ফুটবল মাঠে নিজের পরিবারের অপমান মেনে নিতে পারেননি তিনি।
এ ভাবেই রাজনীতি মিশে আছে ফুটবলের পরতে পরতে। ফুটবলে এ ভাবেই মিশে যাচ্ছে যুদ্ধ, উদ্বাস্তু সমস্যা, লোভ, জাতিসত্তায়। ভবিষ্যতের জিদানরা হয়তো এখন সাঁতরে পার হচ্ছে ভূমধ্যসাগর। কোনও রকমে পাড়ে পৌঁছে বেঁচে যাওয়া শিশুটিই হয়তো আগামী দিনে বিশ্বজয়ের হুঙ্কার দেবে।

সেই লড়াইয়ের একটাই সীমান্ত, একটাই জার্সি, একটাই দেশ। তার নাম ফুটবল।

 
Top