অলিভিয়া সরকার মানেই বাংলা টেলিভিশনের গ্ল্যামার গার্ল।
‘মিলনতিথি’-র দোয়েল হোক বা ‘সীমারেখা’-র টিয়া, তিনি সব রকম চরিত্রে সাবলীল।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর লক্ষাধিক ফলোয়ার্স। তথাকথিত ‘নায়িকা’ চরিত্রে যাঁরা
অভিনয় করছেন বা করেছেন, তেমন অনেকের থেকেই কিন্তু জনপ্রিয়তায় এগিয়ে
অলিভিয়া। শুধু তাই নয়, চরিত্র যেমনই হোক, পর্দায় তাঁর উপস্থিতি অত্যন্ত
শক্তিশালী। তাঁর সংলাপ বলার ভঙ্গিমা, চরিত্র অনুযায়ী নিজেকে ক্যারি করা,
সবকিছুর মধ্যেই একটা প্রচ্ছন্ন আত্মবিশ্বাস খেলা করে।
আজকের অলিভিয়া আক্ষরিক অর্থেই অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু চিরকালই এমনটা ছিল
না। দশ বছর আগে একদম শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন তিনি। এবেলা ওয়েবসাইটের
অনুরোধে সেই অবিশ্বাস্য সংগ্রামের গল্প শোনালেন অলিভিয়া—
‘‘আমার তখন ১৫ বছর বয়স। ‘ডান্স বাংলা ডান্স’-এর অডিশন দেওয়ার জন্য প্রথম
দুর্গাপুর থেকে কলকাতায় আসি। একটা পিজি-তে থাকতাম। সেই সময় আমাদের আর্থিক
অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না এবং বাবার খুব একটা পছন্দ ছিল না যে আমি এই
ফিল্ডে কিছু করি। আসলে বাবা চাইত, আমি অ্যাথলেটিক্সে যাই। বাবা ন্যাশনাল
লেভেল স্পোর্টসপার্সন। দুর্গাপুরে বাবার প্রচণ্ড সম্মান, বাবার কোচিং
অ্যাকাডেমি রয়েছে। বাবা চেয়েছিল যে, হয় আমি খেলাধূলো করব নয়তো চাকরি করব।
ওই সময় মা আমাকে প্রচণ্ড সাপোর্ট করেছে। আমি একটা ছোট শহর থেকে এসেছিলাম
বলে সেই পিজি-তে রীতিমতো র্যাগিং করা হতো আমাকে। অনেক রাত সিঁড়িতেও
ঘুমোতে হয়েছে। আমি তখন খুব ক্যাবলা ছিলাম, আনস্মার্ট ছিলাম। এরকম ভাবে
অনেকদিন সহ্য করেছি।
সারভাইভ করার জন্য সেই সময় জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে, ২০০ টাকা প্রতিদিন
হিসেবেও কাজ করেছি। এরকমও দিন গিয়েছে যে, পাঁচ টাকার ম্যাগি কেনার মতোও
টাকা নেই হাতে। কিন্তু আমি মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছি, কারণ মায়ের স্বপ্ন ছিল
মেয়েকে সিলভার স্ক্রিনে দেখবে। প্রথম বছর আন্ডারএজ বলে ‘ডান্স বাংলা
ডান্স’-এ চান্স পাইনি। পরের বছর, ২০০৯-তে আমি পার্টিসিপেট করি, কিন্তু
সেখানেও একটু সমস্যা হয়। জন্ডিস হয়ে যায়, প্রচণ্ড জ্বরে পড়ি। তার মধ্যেও
পারফর্ম করি কিন্তু এলিমিনেট হয়ে যাই। খুব কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম।
কিছু সময়ের জন্য ভেবেছিলাম যে আর কিছু হবে না, কলকাতায় আর যাব না।
অনেকদিন বাড়িতে বসেছিলাম। তার পরে হঠাৎই বেশ কয়েকটা সিরিয়ালের অফার
আসতে শুরু করল। তবে রাতারাতি সব যে পাল্টে গেল তা নয়। ওই সময়েই একটা অডিশনে
শুনতে হয়েছিল যে, আমি যথেষ্ট গ্রুমড নই তাই আমাকে কাস্ট করা যাবে না। তার
পরেও একটা সময়ে খুব মনের জোর নিয়ে কলকাতায় শিফট করলাম। মা-বাবা দেখল যে
টুকটাক কাজ যখন আসছে, তখন কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করুক। একটা ছবির অফার
এসেছিল, যে ছবিটা কোনওদিনই চলেনি কিন্তু একটা পোস্টার পড়েছিল টালিগঞ্জ
পাড়ায়। ওই সময়েই একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে শুরু করি কলকাতায়। ওই ফ্ল্যাটে
কিচ্ছু ছিল না। শুধু একটা স্টোভ ছিল যেখানে দিনে দু’বার ম্যাগি বানিয়ে
খেতাম। এইভাবে দিনের পর দিন কাটিয়েছি। হেঁটে হেঁটে অডিশন দিতে গিয়েছি। এমনও
সময় এসেছে যে মাসের শেষ, ম্যাগি কেনারও টাকা নেই, বাবার কাছে চাইতে পারিনি
আর। বাড়িতে দুটো পচা আলু পেয়েছিলাম। সেটাই সেদ্ধ করে নুন দিয়ে খেয়েছিলাম
রাতে। কিন্তু গিভ আপ করিনি।
প্রচুর অডিশনে রিজেক্টেড হয়েছি আর সেই রিজেকশনটা একটা সময় সয়ে গিয়েছিল।
তখন রিজেক্টেড হব ভেবেই অডিশন দিতে যেতাম কিন্তু অডিশন দেওয়া ছাড়িনি। তার
পরে আস্তে আস্তে কাজ এল— ‘দুই পৃথিবী’, ২০১৩-তে। তার পরে আবার একটা বছর বসে
গেলাম। একবার কাজ করার স্বাদটা পেয়ে যখন মানুষ বসে যায়, তখন নানা রকম
ডিপ্রেশন মনের মধ্যে আসতে থাকে। নিজেকে বোঝাতে শুরু করলাম। আমার কোথায়
কোথায় ভুল, সেটা খুঁজে বার করে সেগুলোকে বদলাতে থাকলাম। আমাকে একদিন শুনতে
হয়েছিল যে, আমি ওয়েল-গ্রুমড নই। আমি নিজেকে গ্রুম করা শুরু করলাম
প্রচণ্ডভাবে। ওই সময়েই আমি একবার মুম্বই যাই। খেলাচ্ছলে অডিশন দিয়েছিলাম—
‘ইন্ডিয়াজ বেস্ট জি সিনেস্টার কি খোঁজ’-এ। অনেক রিকোয়েস্ট করে যাতায়াত
ভাড়াটা চেয়েছিলাম বাবার কাছে। কিন্তু হাতে বেশি টাকা নেই। সারাদিন না খেয়ে
একটার পর একটা লেভেল পেরিয়েছি। যখন সারা দেশ থেকে ৫০ জনের মধ্যে পৌঁছলাম,
তখন হঠাৎ করে নিজের মধ্যে কনফিডেন্স আসতে শুরু হল। শেষ ৩৫-এ গিয়ে
এলিমিনেটেড হয়েছিলাম কিন্তু ওই অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এর পরে ২০১৪ সালে ‘ঠিক যেন লাভ স্টোরি’-তে একটা ক্যামিওর অফার আসে ৬টা
এপিসোডের জন্য। ভাবতে পারিনি ৬ দিনে এতটা ভালবাসা পাব মানুষের কাছে। আমাকে
অনেকটা শক্তি দিয়েছিল ওই কাজটা এবং এর পরে ব্যাক টু ব্যাক কাজ আসতে শুরু
করল। প্রথম দিকটায় একটাও কাজ ছাড়তাম না কিন্তু একটা সময় পরে গিয়ে মনে হল
যে, এবার আমি আরও একটু ভাল চরিত্র বা কাজ ডিজার্ভ করি। মজার ব্যাপারটা হল—
তার পরে আমাকে হঠাৎ করে শুনতে হল যে, আমি এতটাই বেশি গ্রুমড হয়ে গিয়েছি যে
আমাকে নেগেটিভ চরিত্র ছাড়া নাকি মানায় না। যে মানুষটা ওয়েল গ্রুমড হয়নি
বলে রিজেক্টেড হয়েছিল একদিন, তাকেই পরে এই কথাটা শুনতে হয়েছিল! যে ফ্ল্যাটে
একটা গদি পেতে শুতাম, সেই ফ্ল্যাটটা যখন নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে সাজাতে
শুরু করলাম, তখন নিজেকে বলতে শুরু করলাম— ভাগ্যিস অলিভিয়া তুই ছাড়িসনি।
আজ যখন বাবা আমার বাড়িতে আসে, তখন বলে যে ‘অ্যাম প্রাউড অফ ইউ, তুমি আমাকে
ভুল প্রুভ করে দিয়েছো। তুমি পেরেছো।’
আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য। মা-বাবা... এই দুটো মানুষকে খুব ভাল জীবন
দিতে হবে। তাই আমার জীবনে যতই ওঠাপড়া আসুক, আমি ছাড়ব না। আর জীবন ছেড়ে
চলে যাওয়ার কথা তো কখনও মাথাতেও আনব না। কারণ কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই
দুটো মানুষকে কখনও আঘাত করব না, যারা তাদের সর্বস্ব দিয়ে আমার স্বপ্ন পূরণ
করেছে।’’