পূর্বানুবৃত্তি:
আহিরীকে দেখে বিতান চমকে গেল। সে
ভাবতেই পারেনি আহিরী তার ফ্ল্যাটে আসবে। আহিরী
বিতানের ঘরে ঢুকে জানাল তার খুব খিদে পেয়েছে। তার
পর হাতমুখ ধোবে বলে বাথরুমে ঢুকে শেষে শাওয়ার খুলে চানই করে নিল। বেরিয়ে
কী মনে করে বিতানের জামাকাপড় পরে নিল।
আহিরী
মাথার চুল বাঁচিয়ে গা ধুয়েছে, তার পরেও কিছুটা জল লেগেছে। সেই
জল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘‘নিজের জামাকাপড় চিনতে পারছ না? একে বলে ট্র্যাক প্যান্ট, আর এটা একটা ফুল স্লিভ শার্ট। তোমার
জামাকাপড়ের স্তূপ থেকে বের করলাম। চোখগুলো
অমন গোল গোল হয়ে গেল কেন? মনে হচ্ছে ধপাস করে পড়ে যাবে।’’
বিতান
একই রকম অবাক হওয়া গলায় বলল, ‘‘এ সব কখন পরলে?’’
‘‘কখন
পরেছি তাতে তোমার কী? ঘড়ি ধরে জামাপ্যান্টের ভাড়া আদায় করবে না কি?’’
বিতান
কথা গুলিয়ে বলল, ‘‘না, তা নয়...।’’
আহিরী
কড়া গলায় বলল, ‘‘তোমার এখানে অন্য কারও স্নান করা বারণ? বন্ধু বকবে?’’
বিতান
জিভ কেটে বলল, ‘‘তা কেন? ভাল করেছ। বেশ
করেছ। আসলে
এই ড্রেসে তো তোমাকে কখনও দেখিনি, তাই চমকে গেছি।’’
আহিরী
হেসে বলল, ‘‘রসিকতাসম্রাট, এত ঘাবড়াবেন না। মনে
রাখবেন, রসিকতা আমিও জানি। অনেক
ক্ষণ ধরেই মনটা স্নান-স্নান করছিল। ওয়াশরুমে
ঢুকে শাওয়ারটা দিলাম খুলে। গা
ধোওয়ার পর মনে হল, শাড়ির ভারে জবুথবু হয়ে না থেকে হালকা কিছু পরি। কিছু
ক্ষণ তো এখানে আছি। দেখলাম,
তোমার জামাপ্যান্টই বেস্ট। কেমন
লাগছে আমাকে?’’
বিতান
এক পা পিছিয়ে, ভুরু কুঁচকে, এ পাশ- ও পাশ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘‘হলিউডি মুভির কোনও নায়িকার মতো। সিক্সটিজ়ের
কোনও এক জন... গ্রেস কেলি? অড্রে হেপবার্ন? মেরিলিন মনরো? চিন্তায় ফেললে। কোন
জন, ঠিক ধরতে পারছি না। দাঁড়াও
বলছি। আর
একটু দেখতে হবে।’’
আহিরী
দু’হাতে বিতানের গলা চেপে ধরল।
‘‘একদম
খুন করে ফেলব। আমার
রূপ নিয়ে ঠাট্টা? জানো, এই রূপের জন্য দেশে-বিদেশে কত লোক পাগল!’’
বিতান
কান্নার অভিনয় করে বলল, ‘‘মরে যাব... মরে যাব। ট্রে
উল্টে পড়বে।’’
আহিরী
বলল, ‘‘পড়ুক। আগে
স্যরি বলো।’’
বিতান
বলল, ‘‘স্যরি, স্যরি, স্যরি।’’
আহিরী
হেসে, গলা ছেড়ে, ডান হাত দিয়ে বিতানের নাক নেড়ে দিয়ে বলল, ‘‘গুড বয়। দাও
এ বার কী করেছ। খিদে
ডবল হয়ে গেছে।’’
ডিভানের
উপরেই ট্রে রাখল বিতান। দুটো
বড় বড় মেলামাইনের বাটি। চামচও
দেওয়া আছে।
‘‘এই
নাও, ইতালিয়ান ডিশ। দ্য
গ্র্যান্ড পাস্তা।’’
আহিরী
বাটি হাতে নিয়ে চোখ বড় করে বলল, ‘‘এই তোমার রান্না!’’
বিতান
বলল, ‘‘অবশ্যই। ঠিকমতো
পাস্তা রান্না করা কম খাটুনি না কি? তোমাদের ভাত আর মাছের ঝোলের থেকে মোটেই কম নয়। আমি
তো বেশির ভাগ দিনই এতেই লাঞ্চ সারি। চিজ,
দুধের পরিমাণ ঠিকমতো হয়েছে কি না দেখো। তুমি
খাবে তাই নার্ভাস হয়ে বানিয়েছি।’’
আহিরী
উৎসাহে চামচে করে তুলে একটু মুখে দিল। তার
পর চোখ বঁুজে বলল, ‘‘ফ্যান্টাস্টিক!’’
বিতান
খুশি-খুশি গলায় বলল, ‘‘এই জন্যই বলছি, চিন্তা কোরো না। চাকরি-বাকরি না পোষালে একটা রেস্টুরেন্ট খুলব। কলকাতা
এখন সিটি অব রেস্টুরেন্টস। সেই
সিটিতেই ঠঁাই হবে মোর।’’
আহিরী
হাসি-হাসি মুখে খেতে লাগল। নুন
কম হয়েছে। রসুনকুচিও
আর একটু দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু
সে সমালোচনার মধ্যে গেল না। বিতানের
খুশির কাছে এই সব অতি তুচ্ছ। শুধু্
বিতান কেন, সে নিজেও খুব খুশি। আজ
না এলে অনেক ভাললাগা মিস হত। কম
বয়সে প্রেম করা হয়নি। প্রেম
যখন হল, তখন অনেকটা পরিণত হয়ে গিয়েছে সে। ফলে
প্রেমের হইহই ব্যাপারটা পাওয়া হয়নি। আজ
সে তার স্বাদ পাচ্ছে। বিতানের
ভিতরের এই ছেলেমানুষটাকে দেখা হত না। শুধু
কি বিতানের ছেলেমানুষি? সে নিজেও তো ছেলেমানুষ হয়ে গিয়েছে!
‘‘আজ
না এলে এই চমৎকার খাওয়াটা মিস করে যেতাম বিতান। বাড়িতে
ফোন করে বলে দিচ্ছি— ডিনার অফ।’’
বিতান
বলল, ‘‘দূর, এখন তো মোটে সাতটা। একটু
পরেই খিদে পাবে। জানো
আহিরী, সত্যি সত্যি ভাবছি বিজ়নেস করব। কারও
আন্ডারে চাকরি-টাকরি করা আমার পোষাবে না।’’
আহিরী
খুব সহজ ভাবে বলল, ‘‘রেস্টুরেন্ট খুলবে?’’
‘‘না
না, ও তো মজা করলাম। অত
টাকাপয়সা কোথায়? অন্য কিছু ভাবতে হবে।’’
আহিরী
খাওয়া শেষ করে বাটি-চামচ নামিয়ে বলল, ‘‘ও সব পরে ভেবো। তোমার রান্নায়
যদি নম্বর দেওয়ার কোনও স্কোপ থাকত, তা হলে আমি অনেক নম্বর দিতাম।’’
বিতান
কুর্নিশ করার ভঙ্গি করে বলল, ‘‘এ বার কফি হবে জঁাহাপনা!’’
বিতান
কফি করতে গেলে আহিরী উঠে জানালার ধারে দঁাড়াল। কাচের
বড় বড় দুটো জানলা। বাইরে
আকাশ ভরা তারা। নীচ
দিয়ে বাইপাস ছুটছে। গাড়ির
হেডলাইট আলোর মালা তৈরি করেছে। দূরের
আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোতে বিন্দু বিন্দু আলোর ফোঁটা। কাচ
সরাতে হুড়মুড় করে খানিকটা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়ল ঘরে। আহিরীর
চুল এলোমেলো করে দিল।
‘‘এই
নাও।’’
বিতান
কখন পাশে এসে দঁাড়িয়েছে, বুঝতে পারেনি আহিরী। তার
হাত থেকে কফির মগ নিয়ে আহিরী নিচু গলায় বলল, ‘‘এই জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। এখান
থেকে বাইরেটা দেখতে এত ভাল লাগছে!’’
বিতান
হেসে বলল, ‘‘আরও সুন্দর করে দেব?’’
আহিরী
কৌতূহল নিয়ে তাকাল। বিতান
ঘরের লাইটগুলো নিভিয়ে দিয়ে মিউজ়িক সিস্টেমে গান চালাল। গমগমে
পুরুষকণ্ঠ গেয়ে উঠল— ‘আই লাভ ইউ বিকজ় ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, ডিয়ার...’
আহিরীর
পাশে এসে দঁাড়াল বিতান। নিচু
গলায় বলল, ‘‘জিম রিভস গাইছেন।’’
সত্যি
জায়গাটা আরও সুন্দর হয়ে গেল। আহিরীর
এ বার মনে হচ্ছে, সে আকাশেই দঁাড়িয়ে আছে। সে
কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল।
বিতান
গাঢ় স্বরে বলল, ‘‘তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে আহিরী।’’
আহিরী
জানালায় হাত রেখে বলল, ‘‘বকাঝকা করছি না বলে?’’
বিতান
বলল, ‘‘সেটা এক রকম সুন্দর। এটা
আর এক রকম।’’
আহিরী
হেসে ফিসফিস করে বলল, ‘‘ও, বুঝেছি। তোমার
পোশাক পরেছি তাই।’’
বিতান
বাইরের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘‘মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে। আমার
সঙ্গে দেখা হয়ে তোমার কষ্টই বাড়ছে। কত
ভাল ছেলের সঙ্গে তোমার দেখা হতে পারত। হবেও,
আহিরী। সে
তার বন্ধুর নয়, নিজের ফ্ল্যাট থেকেই তোমাকে এমন সুন্দর একটা আকাশ দেখাবে। আমাকে
ভুলে যাও আহিরী। আমার
অনেক গোলমাল। অনেক
ভুল। তোমার
পাশে আমাকে মানায় না।’’
আহিরী
দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে বিতানের ঠোঁটের উপরে হাত রাখল। বলল,
‘‘চুপ, একদম চুপ। আর
এক বার এ সব বললে খুন করে ফেলব।’’
বিতান
আহিরীর হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘‘এটাই তো সত্যি আহিরী। জীবন
সম্পর্কে আমার ভাবনা যে একেবারে ছন্নছাড়া। তোমাদের
সুরের সঙ্গে তা মিলবে না। তোমাদের
পরিচিতজনের কাছে বলার মতো কোনও পরিচয় আমার নেই। কেউ
যখন বলে তোমার সঙ্গে আমাকে দেখেছে, সঙ্কোচে মরি। তোমার
কথা ভেবে গুটিয়ে যাই। আমাকে
ভুলে যেতে হবে তোমায়।’’
আহিরী
এগিয়ে গিয়ে তার দুটো হাত বিতানের দুই কঁাধে রাখল। তার
পর নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরল বিতানের ঠোঁটের ওপর। এক
সময় মুখ তুলে অস্ফুটে বলল, ‘‘আমাকে তোমার অগোছালো ঘরে নিয়ে চলো বিতান। প্লিজ
নিয়ে চলো।’’
বিতান
আহিরীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।
১৪
শ্রীকণার
শরীর ভাল নেই।
সকালে
বাথরুম থেকে বেরোনোর সময় মাথা ঘুরে গেল। তিনি
দরজা ধরে নিজেকে সামলেছেন। টলমলে
পায়ে ঘরে এসে খাটের ওপর কিছু ক্ষণ বসে রইলেন। ধীরে
ধীরে শরীরটা ঠিক হল। তার
পরেই উঠে পড়েছেন। অনেক
কাজ। যতই
লোক থাকুক, তাদের বলে না দিলে ঠিকমতো কিছু করে না। কলকাতায়
আসার পর সৌহার্দ্য এক জন এক জন করে হেল্পিং হ্যান্ড বাড়িয়েছে। শ্রীকণা
বারণ করলে শোনেনি।
‘‘অনেক
করেছ, আর নয়।’’
শ্রীকণা
বলেছিলেন, ‘‘দুটো তো মোটে মানুষ, রান্নাটা তো অন্তত আমাকে করতে দিবি। তার
মধ্যে তুই তো বেশির ভাগ দিনই আবার বাড়িতে খাস না। রান্নার
জন্য লোক রেখে কী হবে?’’
সৌহার্দ্য
বলেছে, ‘‘অনেক হেঁশেল ঠেলা হয়েছে মা। তোমার
জীবন থেকে ওই ফেজ় এখন গন। এখন
থেকে তুমি শুধু ইনস্ট্রাকশন দেবে আর এক একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়ে আমাকে খাওয়াবে।’’
সকালের
এই সময়টায় শুয়ে থাকলে চলে না। তা
ছাড়া শুয়ে থাকলেই সৌহার্দ্যর সন্দেহ হবে। শরীর
খারাপ, বুঝলেই জোর করে শুইয়ে রাখবে। মাথাই
তুলতে দেবে না। মায়ের
কিছু একটা হলে বড্ড খেপামি করে ছেলেটা। শ্রীকণা
অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
‘‘তুই
বাইরে থাকলে কী হত? আমার অসুখ করত না? না কি আমি মরে যেতাম?’’
সৌহার্দ্য
বলে, ‘‘মা, আমি তো বলেছি, যেখানে যাব তোমাকে ব্যাগে ভরে নিয়ে যাব।’’
‘‘ছেলেমানুষের
মতো কথা বলিস না। এ
বার নিজের কথা ভাব। তোর
কিছু হলে কে দেখবে? আমি তো চিরকাল থাকব না। বিয়ে
কর এ বার।’’
সৌহার্দ্য
বলে, ‘‘এই ডায়ালগ বাঙালি মায়েরা দুশো বছর ধরে দিয়ে যাচ্ছে। আর
কত বছর দেবে কে জানে!’’
শ্রীকণা
বলেন, ‘‘কথা ঘোরাস না। এ
বার একটা বিয়ে কর।’’
সৌহার্দ্য
সিরিয়াস হবার ভান করে বলে, ‘‘পাত্রী খুঁজছি মা।’’
শ্রীকণা
স্থির চোখে তাকিয়ে বলেন, ‘‘সত্যি? না কি ঠাট্টা করছিস?’’
সৌহার্দ্য
বলে, ‘‘অবশ্যই সত্যি। এখন
পর্যন্ত সতেরো জনকে পছন্দ করেছি। ওটা
পঁচিশ হলেই তোমার কাছে আসব। লটারি
হবে। লাকি
ড্র। ঝুলি
থেকে তুমি যার নাম তুলবে, তাকেই অ্যাপ্রোচ করব। সে
রাজি হলেই বিয়ে।’’
শ্রীকণা
রেগে গিয়ে বলেন, ‘‘কোনও মেয়ে তোকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। এ
রকম ফাজিলকে বর হিসেবে কে মেনে নেবে?’’
সৌহার্দ্য
কাঁচুমাচু হওয়ার অভিনয় করে বলে, ‘‘সেটাও একটা কথা। মা,
তুমি বরং একটা কাজ করো। পেপারে
‘পাত্রী চাই’ কলমে অ্যাড দাও। সব
সু–এর ওপর ছাড়বে। সুদর্শন,
সুচাকুরে, সুচতুর, সুফাজিল পাত্রের জন্য সুপাত্রী চাই।’’
শ্রীকণা
হেসে ফেলে বলেন, ‘‘ছোটবেলায় তো এত পাজি ছিলি না সোহো! সারা ক্ষণ কেমন বই মুখে বসে থাকতিস!’’
সৌহার্দ্য
দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে নাটকীয় কায়দায় বলে, ‘‘এই সমাজ, এই সংসার আমাকে পাজি বানিয়েছে।’’ তার
পর কাছে এসে বলে, ‘‘আসলে কী জানো মা, বাবার দাপটে গুটিয়ে থাকতাম। প্রাণ
খুলে হাসতেও পারিনি। তুমিও
তাই।’’
শ্রীকণা
বলেন, ‘‘থাক ও সব পুরনো কথা। এ
বার তোর দাপট থেকে আমাকে বঁাচতে দে দেখি!’’
সৌহার্দ্য
বেলা করে ওঠে। উঠেই
অফিসের জন্য হুটোপাটি শুরু করে দেয়। শ্রীকণা
রান্না না করলেও ছেলের ব্রেকফাস্ট নিজের হাতে গুছিয়ে দেন। সেই
ব্রেকফাস্ট কোনও রকমে গিলতে গিলতে ছেলে দৌড় লাগায়। আজ
ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন, সৌহার্দ্য ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। ডাইনিং
টেবিলে বসে ল্যাপটপে খুটখাট করছে।
শ্রীকণা
বললেন, ‘‘আজ হল কী! সকাল সকাল উঠে পড়েছিস যে বড়?’’
সৌহার্দ্য
বলল, ‘‘ভাল ছেলে হয়ে গেছি মা। চা
দাও। চা
খেতে খেতে তোমার সঙ্গে কথা আছে।’’
শ্রীকণা
রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘‘তোর সঙ্গে কথা বলার মতো সময় আমার নেই।’’