ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার শেষ নেই; তবু বাড়ি যেতে চাই, বাড়ি যেতেই হবে- এমনই
আকুলতা-ব্যাকুলতা রাজধানীর ঘরমুখো মানুষের। বাসা থেকে বের হওয়ার পর
হাজারো বিড়ম্বনা, যানজট আর যানবাহনের নানা সমস্যায় মানুষকে হিমশিম খেতে
হচ্ছে তারপরও নাড়ির টানে মানুষ ছুটছে বাড়ির দিকে স্বজনদের সঙ্গে ঈদের
আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। যে কোনো মূল্যে ও যত কষ্টই হোক, প্রিয়জনের
সঙ্গে ঈদ করতে হবে। কিন্তু' সে আনন্দ উপভোগ করতে ঈদে বাড়িফেরা মানুষকে
পোহাতে হচ্ছে অসহনীয় দুর্ভোগ।
ঈদ উদযাপনকে কেন্দ্র করে ট্রেন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালগুলো সরেজমিন ঘুরে
সে রকম চিত্রই দেখা গেছে। প্রতিটি টার্মিনাল লোকে-লোকারণ্য। প্রতিটি
র"টের যানবাহন মানুষে ঠাসা। নাড়ির টানে সাড়া দিয়ে লাখো মানুষ ভিড় করছে
কমলাপুর রেলস্টেশন, গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী আন্তঃনগর বাস
টার্মিনালগুলোতে। আর বরিশাল, ভোলা, বরগুনা ও পটুয়াখালী গামী ঘরমুখো মানুষ
ভিড় করছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। সব মিলিয়ে ঢাকা ছাড়ার সব পথই ছিল নাড়ির
টান অনুভব করা মানুষের পদভারে মুখর।
সরকারিভাবে এবার ২৯ জুলাই সম্ভাব্য ঈদুল ফিতর ধরে ২৮ থেকে ৩০ জুলাই ঈদের
ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছুটি থাকবে সোম, মঙ্গল ও বুধবার তিন দিন। এর আগে
ও পরে রবি ও বৃহস্পতিবার একদিন করে অফিস খোলা রয়েছে। সে হিসাবে কর্মজীবী
মানুষের ঈদের আগে শেষ অফিস আজ। অফিস শেষ করে শ্রম পেশার মানুষরা ছুটবে
নাড়ির টানে। ফলে রাজধানী ঢাকা প্রায় ফাঁকা হয়ে যাবে। এরই মধ্যে
শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটিকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার থেকেই রাজধানী
ঢাকা ফাঁকা হতে শুর" করে।
বাস, রেল আর লঞ্চঘাটে তিল ধারণের ঠাঁই নেই এখন। শনিবার সকাল থেকেই
বিভিন্ন এলাকার যাত্রীরা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে আসতে থাকেন। সবাই
তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যের বাসের জন্য ওদিক-ওদিক ছুটতে থাকেন। প্রতিবারের
মতো এবারও নানা রকমের হয়রানির শিকার হন যাত্রীরা। যানজট, পরিবহন সঙ্কট,
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যাত্রীদের মালামাল নিয়ে টানাটানি, যাত্রীদের
টানাটানি করতে গিয়ে বাস শ্রমিকদের মধ্যে কথা কাটাকাটি, ঝগড়া। সায়েদাবাদ
বাস টার্মিনাল থেকে মূলত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি,
বান্দরবান, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, মাদারীপুর,
শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, সিলেট, খুলনা ও মাদারীপুরের উদ্দেশে বাস
ছেড়ে যায়।
ইলিয়টগঞ্জ এক্সেপ্রসের কাউন্টার থেকে মুরাদনগরে যাওয়ার জন্য টিকিট
কিনছিলেন মানিক চাঁদ। হঠাৎ কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতার সঙ্গে তার ঝগড়া
বেধে যায়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে হাতাহাতিতে রূপ নিচ্ছিল। তবে সমস্যার
সমাধানে কয়েকজন যাত্রী এগিয়ে এলে ঘটনাটি বেশি দূর বাড়েনি। জানা যায়,
নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে টিকিটের দাম বেশি চাওয়ায় যাত্রী মানিক ক্ষেপে
গিয়েছেন। এছাড়া চাঁদপুরগামী পদ্মা, তিশা ইত্যাদি পরিবহনে অন্যান্য সময়
২০০ টাকা ভাড়া হলেও এখন যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা।
নোয়াখালী-রামগঞ্জ ভাড়া ৩৩০ টাকা হলেও ঈদ উপলক্ষে নেয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা।
মাদাইয়ার ভাড়া ১২০ টাকা হলেও ঈদ উপলক্ষে নেয়া হচ্ছে ২০০ টাকা।
কমলাপুর রেলস্টেশন ঘুরে দেখা যায়, ট্রেনের বগি, ছাদ, ইঞ্জিন- সর্বত্রই
ঘরমুখো মানুষ আর মানুষ। প্রিয়জনদের সঙ্গে খুশির ঈদ উদযাপনে এভাবে ঝুঁকি
নিয়েই রাজধানী ঢাকা ছাড়ছেন হাজার হাজার মানুষ। রেলস্টেশন সূত্র জানায়,
দীর্ঘ লাইন ধরিয়ে পাঁচ দিন ধরে বিক্রির পরও কয়েক হাজার মানুষ টিকিট
পাননি। তবে ট্রেনে যেতে স্টেশন অভিমুখে জনস্রোত লেগেই আছে। যে যেভাবে
পারেন ট্রেনে উঠছেন।
নদীপথে গ্রামের বাড়ি যেতে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ভিড় করছেন ঘরমুখো
মানুষ। লঞ্চগুলোতে তাই তিল ধারণের জায়গা নেই। অতিরিক্ত যাত্রী উঠানো
হচ্ছে, এমন অভিযোগও রয়েছে। তারপরও নাড়ির টানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি
ফিরছে মানুষ। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব নৌযানের প্রায় ৯ হাজার কেবিনের
বুকিং এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আগাম টিকিট না পেয়ে অনেক যাত্রী হতাশায়
পড়েছেন। বি আইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা
জানান, নৌপথের যাত্রীদের নিরাপত্তা ও হয়রানি রোধে সদরঘাট টার্মিনাল
এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কোনো লঞ্চে যাতে অতিরিক্ত
যাত্রী না ওঠে, সেদিকেও তারা লক্ষ রাখবে। এমভি মিতালি-৪ লঞ্চের মাস্টার
মোঃ কামালউদ্দিন জানান, গত ঈদের চেয়ে এবার যাত্রীর সংখ্যা বেশি। কারণ গত
ঈদে হরতাল থাকায় অনেকে ঢাকায় ঈদ করেছেন। তিনি বলেন, যাত্রী বেশি হলেও
যাত্রাপথে কোনো সমস্যা হবে না। এবার এ রুটের নতুন ১৬টি লঞ্চ যোগ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর সায়েদাবাদ, মহাখালী ফুলতলী, গাবতলী
বাস টার্মিনাল থেকে দিনে প্রায় ৫০০ পরিবহন কোম্পানির বাসে লাখ লাখ মানুষ
ঢাকা ছাড়ছে। বাংলাদেশ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ইউজার্স ফোরামের এক গবেষণা
তথ্যে দেখা গেছে, প্রতি ঈদে গড়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে যান।
বিশেষ করে ঈদের আগের তিন দিন ঢাকা থেকে প্রতিদিন গড়ে ১২ লাখ মানুষ
বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে ঢাকা ত্যাগ করেন, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় পাঁচ
গুণ। গাবতলী বাস টার্মিনালের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স
অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া তথ্যে জানা যায়, গাবতলীতে ২০০টি পরিবহন যাত্রীসেবা
দিয়ে থাকে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের সব জেলার বাস এখান থেকেই ছেড়ে যায়। ২
হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ গাড়ি ঈদে গাবতলী থেকে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের
বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
সড়ক পরিবহন সমিতি সূত্র জানায়, রাজধানীর ফুলবাড়িয়া থেকে দিনে ২৫ থেকে
৩০টি পরিবহনের গাড়ি চলাচল করে। আর সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে প্রায় ২০০টি
পরিবহনের বাস চলাচল করে। এখান থেকে সাধারণত সিলেট, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা,
চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, গোপালগঞ্জ,
সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ফেনী, নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,
লক্ষ্মীপুর, বরিশাল জেলার উদ্দেশে গাড়ি ছেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একদিকে গণপরিবহনের অভাব, অন্যদিকে অপরিকল্পিত
ট্রাফিক র্যাবের কারণে রাজধানীর যানজটের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে
কর্তৃপক্ষ। গণপরিবহন কম থাকায় প্রতিদিন অফিস ছুটির পর সড়কে যাত্রীদের
ভিড়ে চলাচল করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। একই গাড়িতে জোরাজোরি করে ওঠার চেষ্টা করে
অনেকে উঠতে পারছেন তো আবার অনেকে ঝুলে ঝুলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গন্তব্যে
ফিরছেন। এটি এখন রাজধানীর নিত্যদিনের সঙ্গী।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীতে চলাচলকারী মানুষের মধ্যে হেটে চলেন ২০
শতাংশ মানুষ, ৩৮ শতাংশের যাতায়াত হয় রিকশায়, বাসে যাতায়াত করেন ২৮ শতাংশ
মানুষ, বাকি ১৪ শতাংশ লোক যাতায়াত করেন হিউম্যান হলার, সিএনজি, অটোরিকশা,
প্রাইভেট কার, টেম্পোতে। এর মধ্যে প্রাইভেট কারে চলাচল করেন মাত্র ৬
শতাংশ মানুষ, আর ৬ শতাংশ মানুষের জন্য সড়কের ৪০ শতাংশ জায়গা দখলে থাকে
প্রাইভেট কারের। সড়কের মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ বাসের দখলে থাকে।